আলোপৃথিবী

একটি আলোপৃথিবী প্রকাশনা উদ্যোগ

  • হোম
  • আমাদের কথা
  • প্রকাশনা
  • নিয়মাবলী
  • ই- লাইব্রেরি
  • যাপনচিত্রকথা
  • যোগাযোগ
  • মন্তব্য
Home Archive for May 2020


নির্বাণ তবু নির্বাণ নয়

১.


কামুক বাতাসে গা ভিজিয়ে নিচ্ছে বেনা।চুরি রাহাজানি ছিনতাই
হাতকাটা গদাই টইটম্বুর। আগুন আর আগুনের গান এক নয়,
উপলব্ধির ব্যাপার।জীবন আগুন হলে ছবি হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
পলাশ আর রুদ্রপলাশ আলাদা। শঙ্খ আর শঙ্খলাগা এক নয়।
এলোমেলো বাতাসের ঢেউ কেটে কেটে যাওয়া।উপলব্ধির ব্যাপার
ও যাপন বড়ই আলাদা।দম লেগে যায়,হাঁপ ধরে আসে,গা-বমির
মধ্যে থেকে জেগে ওঠে হিংস্রতা। পেলব কোমল একটা বিছানা
শুধু তাড়া করে ফেরে। মৃত্যুর অলীক




২.


এই একরত্তি লাশকাটা ঘরে পুঁজ রক্ত অর্ধগলিত শব নাড়িভুঁড়ি
দমবন্ধ করা বাতাস থকথকে রক্তমাখা কর্দম। বিষাক্ত মনিরুল
ততোধিক বিষাক্ত তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস।এ রাজ্যের রাজা,মৃতের
দেবতা, হেড ডোম।বহু উজান আর ভাঁটির এ জীবন সন্ত্রাসের
থাবা। হাড়হিম।  রক্তকে চলার পথেই জমাট আর কঠিন করে 
দিতে পারে।সারা শরীরে রক্তের বরফ নিয়ে হেঁটে বেড়ায় মনিরুল।
অথচ কত লঘু আর তুচ্ছ তবু আনন্দময় প্রতিদিনকার খিল্লি।
সস্তা যাপন।গান ভালবাসা মদ্যপান। কিম্ভূতকিমাকার দুঃস্বপ্নেরা
ভিড় করে আসে মৃদু অবসরে।আর অনন্ত এক ভয় ফাঁক গলে
শক্ত ও শুকনো হাড়ের আঙুলগুলো দিয়ে গলা টিপে ধরে সজোরে।
তবু লাশ ভাল লাগে । মানুষকেই বড় ভয়




৩.


‘হিম হিড়বিড় হ্র্যাম’, স্বগত ভাষণে দাঁড়িয়ে স্টেশন চত্বরে।দৃপ্ত
 ইশারার মত মুষ্ঠিবদ্ধ হাত পিছনে।চলমান।আপেক্ষিকতার সব
শৃঙ্খল ছিঁড়ে গগনবিহারি।ওকি শিক্ষিত? প্রশ্ন জাগে। জটিল ও 
অসম কিছু সূত্র ও সমীকরণে কেঁপে ওঠে তার ঠোঁট, চোখের 
সজল। এক ঈগলের ডানা থেকে চুঁয়ে পড়া জল তাকে ধৌত 
করেছে।পরিপাটি।পায়চারিরত। এই জনারণ্যে পরিত্যক্ত গুহায়
তার ছায়াছায়া অন্ধকার যাপন। সুমুদ্রগর্ভে এক প্রবাল প্রাচীর
একটু একটু করে বেড়েই চলেছে।দুহাত উপচে ওঠে সামুদ্রিক
ফেনায়।আরেকটু পিছিয়ে যাব আর রাত্রির জঠর থেকে নিয়ে 
আসব শূন্যতার পানপাত্র,অভিশপ্ত বাগান,নৈঃশব্দ্যের গাঢ় শঙ্খ।
ততদিন আমার এই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দুটি ইশারার মত দুলবে।
তোমরা বলবে পাগলের কান্ডকারখানা




৪.


মাথার চাদর সরিয়ে মাথা ঝাপটায় এরশাদ।মাথার এই ঝাঁকুনিই 
তাকে ক্রমশ নিঃস্ব করেছে একা করেছে নিষ্ঠুর।স্বার্থপর আর পিচ্ছিল 
সরু এক রাস্তা ধরে জীবনের দিকে হেঁটে যায় এরশাদ।অন্ধকার আর 
অন্ধকার—এই তার নিয়তি।মুখের কশ মুছে নেয়। চোখের কালশিটে 
ভাবকে ঢেকে রাখে।সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।কিন্তু বেঁকে যায়।
ক্রমশ বেঁকেচুরে আসে কাঠামো কলকব্জা। আত্মহত্যা এক উপায়।
আততায়ী ও ঘাতক বাহিনীর আত্মরক্ষার কৌশল।হাতের দস্তানার
খুব ভেতরে সেটি থাক গুপ্ত নিরাময় হয়ে। জীবনের দিকে চ্যালেঞ্জ 
ছুঁড়ে দেয় এরশাদ । আর অন্ধকারে আরো অন্ধকার হয়ে মিশে 
যেতে থাকে




৫.


জড়িবুটি মাদুলি তাবিজ কালো ঘোড়ার ক্ষুর ও লোম ঘোড়ার ডিম।
এক জোচ্চুরির ব্যবসায় আছি। তবু ভালবাসি। নাম জাহাঙ্গীর সাকিন 
ছোট মোল্লাখালি। আসলে আমি একজন আর্টিস্ট। কথা কথা কথা 
বাক্‌--পশ্যন্তী মধ্যমা বৈখরি। এতসব আমি জানি না। আমি দেখেছি 
সাপুড়ের বাঁশির সামনে সম্মোহিত সাপ। মানুষও দোলে। আচ্ছা আচ্ছা
লোককে দুলিয়েছি। ‘তিনিই প্রকৃত সেলস্‌ম্যান আলাস্কাতেও যিনি 
ফ্রিজ বিক্রি করতে পারেন’—ম্যানেজমেন্ট গুরু উবাচ। আহা জাদু!
শব্দ ব্রক্ষ্ম ! ওঁ! মিথ্যাকে যিনি সত্য বলে ধাঁধা লাগিয়ে দেন তিনিই
তো খাঁটি আর্টিস্ট। আমি একজন আর্টিস্ট স্যার। আর্ট-ই আমার ধর্ম।
আমাকে জোচ্চোর বলবেন না প্লিজ


( বি.দ্র.—টানা গদ্যে কম্পোজ হবে।)


শর্তাবলী প্রযোজ্য


চিরকাল অবিশ্বাসী আচারে  বিচারে
সিঁদুরের লাল থেকে এঁটো ছোঁয়াছুঁয়ি
অসহ্য অপ্রেমে স্পর্শে কিংবা আদরে
এ বাবা এভাবে মেয়েদের যেতে নেই
উচ্চগ্রামে হাসি ঠাট্টা! দুটো মেয়ে একা!
যে সয়, সে রয় মার্কা কথামালা দিয়ে
সাজাতে চেয়েছে যারা উচ্চাসনে বসে
বিশুদ্ধ ঘৃণার চোখে দেখেছি তাদের

ভালবাসা বোধকরি তত শুদ্ধ নয়




প্রতিশোধ


তোমার জানা উচিত।
হাতে কোনও ঠিকানা না নিয়েও শব্দেরা যে পৌঁছে যেতে পারে ঠিক ঠিকানায়, সেটা জানা উচিত।
তাই বার বার ঠিকানা বদল করেও লাভের লাভ কিস্যু হবেনা
শুধু শুধু বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে বর্তমান প্রেমিকটিকে দিয়ে সেসব বইয়ে 
গলির ভেতর গলি তার আবার ডান দিক বাঁ দিক।
তারপর দোতলা একতলা। তালা, চাবি।
জানালা দরজা খেয়াল রাখা সব সময়!
আওয়াজ হলে বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া।  
মাঝরাতে তাকে ঘুম থেকে তোলা।  
তার বোকা বোকা আশ্বাসে সাহস খোঁজার চেষ্টা।
তারপর আবার এক গ্লাস জল ঢোঁক না গিলে খেতে গিয়ে গায়ের ওপর ফেলা।
ঝক্কি কার? তোমার না আমার? 
আমি পিছু নাই নিতে পারি।
নিইনি। কারণ তুমি না জানলেও আমি জানি শব্দের ঠিকানার প্রয়োজন নেই। চাইলেই পৌঁছে যাবে ঠিক ঠিকানায়।
ধীরে হাওয়া বইলেও শব্দ হয়। গাছের পাতা ঝরে পরলেও শব্দ হয়। মেঘেরা স্থান পরিবর্তন করলেও শব্দ হয়। সন্তর্পনে বৃষ্টি নামলেও শব্দ হয়।
আমি পিছুও নিইনি।
কিন্তু এমন কোনও শব্দহীন ঠিকানা খুঁজে পাবে কি তুমি যেখানে গাছ নেই, হাওয়া নেই, মেঘ নেই?
চিরকাল চমকে উঠবে বারবার। বধির হতে চাইবে।
অথচ আমি ডিহিং নদীর ধারে নির্জনে বসে সবুজ জলের শব্দ শুনব আর শুধু শুনতেই থাকব...




সংযোজন


তোমায় যত না ভাবি, তাকে ভাবি আরো বেশি।
উত্তর খুঁজি পাশাপাশি...     
কী সেই আলাদা কিছু, নীরবে করেছ আয়োজন 
সেসব প্রতিফলন কিছু কি পড়েনি মুখে?
আপাতঃ নির্দয় বুকে ভীষণ আলোড়ন!
চেয়েছ আড়াল দিতে, পেরেছ কী  পারোনি
সেসব প্রশ্ন তোলা থাক – 
তাকে শুধু ভেবে গেছি, অলিগলি খুঁজেছি   
আমাদের ‘বিস্তর ফারাক’ 

সেও কি নির্জন? সেও একলা গাছের কাছে বসে?
নাকি কোলাহলময় যান্ত্রিক শব্দে মুড়ে 
নিজেকে বোঝায় অনায়াসে!

তোমার অক্ষর চেনে? সে তোমার লেখা মনে রাখে?
কবিতা কি ভালবাসে? কবিতা জড়িয়ে শুয়ে থাকে?

আদৌ কবিতা পড়ে? (নাকি) অবহেলা করে কবিতাকে!




ভুল


তোমার কথার ভার ছিলনা।
হয়ত তোমার ধার ছিলনা শূন্য হাতে
যখন যখন চাইতে গেছি, তখন তোমার আর ছিলনা একটু সময়
গাছের মত আমিও আছি, বলতে গিয়েও থমকে গেছি
লক্ষ বছর দাঁড়িয়ে থেকেও তাই মনে হয়
সব আগাছাই ঠিক ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে
গাছের তলায় পুড়িয়ে তাদের শোধ করেছি ঋণের হিসেব

আবার ভাবি, ভুল করেছি, ভুল করেছি ফিরিয়ে দিয়ে




লামাহাটা


ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে, ততক্ষণেই রাস্তায়
খানিক ঠাহর করা যায়, ঘন কুয়াশায় চাদরে
বহুদূর গামী চোখ পড়ে যায় চুপ করে থাকা পাইনের
সারি সারি বেঁধে অদূরে দাঁড়ানো, নেই আমি কোত্থাও নেই
এগিয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়, মেঘ ঢুকে আসে সহজেই
ফোঁটা ফোঁটা গলে পড়ছে বাইরে, ফেলে ফেলে যাওয়া স্পর্শে   
চরাচর জুড়ে শব্দহীনতা, দিগন্ত জোড়া স্পন্দন
হয় আমি সর্বত্রই আছি, নয় আমি কোত্থাও নেই!


যদি চর্তুদশপদী


চর্তুদশপদী যদি দু'পায়ে ঘুঙুর চোখে গীত
তুমি কি সন্ধের হয়ে জাদুকরী দেখাবে আমাকে
তুমি কি ছত্তিশগড়ী মুদ্রা হয়ে যাবে দেশাতীতে
রাষ্ট্র যদি অসম্মত, তুমিই পত্র পুষ্প ভূমি ভূমা

আমার স্বরাজ্য নেই দেশ অর্থ দেয়াল ও জুঁই
আমার জুঁই-এর গন্ধ পারাপার করে স্বপ্নলোক
স্বপ্নলোকে ছ-ফোয়ারা জল-শীর্ষাসনে আমি শুই
হেজিমনি বিদ্যুতের, বিদ্যুতের পুত্রকন্যা হোক

চর্তুদশপদী তুমি বিদ্যুতের কারুমুদ্রা নিও
আগুন - জলের দেশে ছায়া থাক তোমার পায়ের
পঙক্তিতে আলো হোক স্তবকের পাশে কালফনী
মিথ নিয়ে হাওয়া যাক এবাংলার এগাঁয়ে ওগাঁয়ে

চর্তুদশপদী যদি শ্রীচরণে রক্তজবা রাখি
দেখাও বিম্বন মায়া বিষাকাশে উড়েছে পাখিরা




টেবিল


পল্লবগ্রাহিতা থেকে মুক্তি দাও বলে যে পাতারা
ঝরেছিল, ছড়িয়েছি গান্ধর্ব - টেবিলে। মধ্যযামে
যাবতীয় সংবিধান লঙ্ঘিত হয়েছে জেনে শ্যাম
মথুরা গেছেন, সাত - আকাশেরা চুপ ; ছন্নছাড়া

বসন্তও বহুগামী - ভিখিরিরা গেয়েছে তেমনই
পর্যাপ্ত ভিখিরি হয়ে অকলঙ্ক খাতায় লিখেছি
কুয়াশা বিস্তর, সব কবিদের জন্য গোপবালী
পুষ্প ব্যবহারে শেখে : ফুলের কাছেই প্রেম ঋনী

কীভাবে শালের বীজ ঘুরে ঘুরে নামে সে সংবাদ
মথুরাপতিকে যেন জানায় অক্রুর ; বাহ্যজ্ঞান ---
শূন্য রাই দেখ-ভাল করেছি এদ্দিন, ক্ষুব্ধপ্রাণে
বলছি আজ বাঁশিটিও সুবিধের নয়, যে কঙ্কাল

ভাসিয়ে নিয়েছে জল এ সনেট আনুক হদিশ
তার, টেবিলে ছড়ানো পাতা ফুল অন্তর্ঘাতী হৃদি




ব্রিজ


ভুমধ্যরাতের শিস শুনেছিল মাইগ্রেন্ট পাখিরা
তাদের চঞ্চুতে চোখে বালিঝড় আমার ভাষার
মতো, তুমি যামিনীর বৃংহন বুঝেই পারাপার
করেছিলে, ব্রিজে ছিল পুরোনো কাঠের আঁকিবুকি

ভাষায় রক্তের ফেনা আলজিভে পরখ করেছি
কতদূর নোনাস্বাদ কতোবেশি জটিল বিস্তার
তার, সেভাবে বুঝিনি ; মাটির নাভিতে ভুখমার
পোকা হয়ে মরে গেছি -- সেই মৃত্যু দিলে বুকভরে

নিয়েছি সে চমৎকার, ওলো এই অন্তিমের দেশে
মনে পড়ে শলাকায় বিদ্ধ হয়ে তোমার অমতে
নিয়েছি গলায় কন্ঠি ; এ বাংলা ভাষার দুই স্তন

পান করে মোক্ষ নেব, মোক্ষের ঘোরালো গ্রন্থি সব
খুলে খুলে ঢুকে যাব সংসক্ত আলোয়, আশৈশব
দেখেছি ব্রিজের নিচে কাঁপে চাঁদ, রাত্রি নামে স্নানে




উপত্যকা


শকুন্তলে নাটকেই ফিরে যাও ; এই উপত্যকা
রোমান্স হারানো ; বহ্নি - তাপে আকাশের উপশিরা
ফেটে পড়ছে স্বভাবত, দূরগামী উপোশী স্মৃতিরা
তাদের তণ্ডুলকণা দিতে হবে, অলীক সুপথ্য

পেয়ে জলজ্যান্ত বাতাসেরা উড়ে এসেছে আবার
ঘোলাটে দুচোখ নিয়ে শাসিয়েছে কড়া মাল্যবান
মেনিটি ফিরেহে ফের ছানা নিয়ে পাশের বাগানে
আকাশের তন্ত্রঘেঁটে ভস্মচাঁদ নিয়েছে আকার

তোমার সংলাপ ঘাঁটি ঘেঁটে দলিলের লাল ফিতে
বাঁধি, অকরুণ এত মোহময় ছিলেনা আগেও
যখন সংক্রান্তি এসে গেয়ে যেত দেহাতি ফাওয়া
যখন অস্মৃতি এসে তাজা ওম এনে দিত শীতে

সেসব শরীরী থেকে স্মৃতিহীন এ উপত্যকায়
আমার সর্বস্ব পোড়ে, আমার সর্বস্ব নিভে যায়




কুয়ো


কক্সবাজারের সন্ধে জহর দেখেছে, আমি নয়
আজমেড় বাজারে কত খুঁজে মরছি সেই কুয়ো যার
জল কখনও নামেনা, সেইসব জলের সংসার
এখনও কল্পিত আলো দেয়, স্বপ্নে খুব ভয়ে ভয়ে

যে দৃশ্য দেখেছি তাকে জহর দেখেনি, আদগ্ধ পা
কেউ শেকলে বেঁধেছে, দুইহাতে ছাপা হলোগ্রাম
কিসের জানেনা কেউ, রেডিওতে শেষ কারিগ্রাম
বিবিধ্ ভারতীর, জান দোকানের পাশে ওপারের

লোকজন, রাধেশ্যাম শা-ই আমার নিয়তি বুঝে
খুঁজছি জাঁহাবাজ সেই দুর্জয়, যে একফালি মেঘ
দেখে বারিষের খোঁজ দেয়, সন্ধে নামছে কুজনের

সন্ধের যাকিছু আজ দু-চোখে নিয়েছি, ছ-দুয়ার
নিষিদ্ধ জেনেও ঢুকি যতিক্ষত পা, রাত্রির মেয়ে
জল চাইছে... তৃষাতুর কৃষ্ণজলে পূর্ণ ছিল কুয়ো




মেয়ে


মেয়ে তুই বিম্ববতী হলে দেখি মুখোস ও মুখ
কতখানি মিলিজুলি, অতিশয় স্যাটান প্রসাদে
উটের গ্রীবার চেয়ে উঁচু হয়ে উঁচুদের রাতে
মাথা ঠেকে নরকের খোলে, চোখে ঘোলাটে কামুক

আমি তোকে নিয়ে যত শিল্পে ও ভ্রমণে গেছি ; যম
কাটাকুটি খেলে গেছে, ভ্রম নালি - ঘা'য় কুক্ষিগত
করেছে উদাস, তুই ঈশ্বরের প্রাসাদের ক্ষত
যতই ঢাকিস হাতে, কারুকাজে, পণ্ড হয় শ্রম

পরুষ-বঁটিতে রেখে আমাকে দু'ফাঁক করে দিলে
এখন বুঝেছি এই পুরুষের কোনও মুক্তি নেই
মুক্তি ওড়ে তোর বদ্ধ আকাশের ওপারে নিখিলে

তোর মুক্তি মঞ্জিরায় ধর্ম তোর স্তনে, ইশারাতে
সব দগ্ধ বৃক্ষ হয় সব বৃক্ষ মেঘের গহনে
পুণ্যজল ভরে, বৃষ্টিজলে ভাসে লিঙ্গ, নিশানাথ


প্রদীপ


যতক্ষণ কাছে ছিল ততক্ষণ বিষাদগুলি আলাদা,
ভাসিয়ে দেওয়ার পর নদীর ঘাট থেকে 
সমস্ত ইচ্ছে-বেদনাকে দেখায় সমান 

যে প্রদীপ হাত ছেড়ে যায় তার আর কোন দুঃখ থাকে না




বুদ্ধ পূর্ণিমা


আগুন আঁকবে ভেবে ভেবে
সাদা ক্যানভাস রেখে শিল্পী চলে গেছে…
এমন এক রাতে কবি লিখেছিলেন-
‘পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে…’  এমন লগনে
সমস্ত পাণ্ডুলিপি খুঁটে খায় প্রিয় বকরং, 
এমন ক্ষণে অন্ধকার শব্দটি লিখতেই
তোমার ভুলে যাওয়া মুখও সুনির্মল আলো…

সবকিছু মিথ্যা অথবা দৃশ্যত, 
চিতায় জ্বলছে চাঁদের বিধবা মুখ




দোষ


দোষ রেললাইনের নয়, দোষ মালগাড়ির নয়,
দোষ ঘুমের নয়, দোষ হেঁটে আসার নয়, 
হেঁটে আসা পথের নয়, দোষ ক্লান্তির নয়,
দোষ সরকারের নয়, দোষ শ্রমিকদের নয়,
দোষ কারোর নয়...

রেললাইনের ওপর পড়ে আছে কয়েকটি রুটি
সমস্ত দোষ ওই রুটির, সমস্ত দোষ মাটির




কামড়


একটা গোটা পাউরুটি খেতে আমার লাগে আট কামড়
গোপাল জ্যেঠুর দশ কামড়
অফিসের বড়বাবুর লাগে ছয় সাত কামড়
ছোট বৌদির তের চোদ্দ কামড়
দিদা খান আস্তে আস্তে কুড়ি বাইশ কামড়ে…

ফুটপাতের কালো বালক 
এক কামড়ে সাবাড় করল গোটা পাউরুটি




মাছরাঙা


বাঁশ পাতা জল ছুঁয়ে থাকে
জলের ভিতরে গৃহবধূর স্বচ্ছ দেহ,
ঢেউটি দুলছে, ঢেউটি ভাঙছে…

স্নানের অন্তরে দেহের ছায়াহীনতা দেখে নিভৃত
মনোবেদনায় মাছ শিকারের পর উড়ে যায় মাছরাঙা,
পুরুষ বাঁশডাল নিঃসঙ্গ জল থেকে শূন্যে লাফিয়ে ওঠে,

মাছরাঙার উড়ে যাওয়া অব্দি বাঁশপাতা জল-ছুঁয়ে থাকে…




মৃত তারার আলো


জানে না বাঁশি, জানে না সেতু,
জানে না গাছ ও অন্ধ ভিখিরি
জানে না মাটি, জানে না সেতার

তারা জানে, সব সম্পর্ক শেষ হলে
যে যত দূরে থাকে যে যত দূরে চলে যায়
আলো মুছতে তত বেশী সময় লাগে তার




স্মৃতি


যতবার এসেছ ততবার ছায়াও এসেছে…

সমস্ত ছায়া আমি সযত্নে গুছিয়ে রেখেছি,
কমলা, বেগুনি, নীল ছায়া, 
অল্পবয়সী ছায়া, বৃষ্টিভেজা ছায়া, 
স্পর্শছায়া, বিরহ স্বভাবের ছায়া,
চিলেকোঠায় সূর্যাস্তে রচিত ছায়া…

তোমার প্রতিটি ছায়া এখন
আলাদা আলাদা মুখ
যার কেউ তুমি নয়।




দাঁড়কাক


গমের দানা
           খুঁটতে খুঁটতে
                    সিঁড়ি বেয়ে
                              দাঁড়কাক  উঠছে
                                          লাফিয়ে লাফিয়ে
                                                               
                                                 সিঁড়ির শেষে
                                         অনন্ত শয়ান,
                                শৈশবের ঘুমন্ত
                      চোখ,  আমি তার 
          ঘুমপাড়ানি গান



মামুলি


কখনো কখনো এভাবেই থেকে যায় কেউ
পাহাড়ি ঝর্ণার পাশ কাটিয়ে
বিকেলের নীল পর্দার পাশ কাটিয়ে
জেগে ওঠা দুপুরের বুদ্ধমূর্তির কাছাকাছি
এভাবে থেকে যাওয়া হয়ত সহজ

এই সব নিয়ে কথা হত আমার আর দিগন্তের মধ্যে
দিগন্ত রায়, নদীর শব্দ শোনাতে পারত যে কোনও সময়
আমরা ঢালু বেয়ে নামতে চাইতাম অযথাই
আর সন্ধে হয়ে আসত
এভাবেই থেকে যাওয়া যায় কি না
তা নিয়ে ভাবার আর সময় থাকত না

এভাবে থাকতে চাওয়ার মধ্যে যে ভুল কিছু আছে, তা নয়
পুরনো কাঠের আসবাব যেভাবে থেকে যায়
জঙ্গলের মধ্যে যেভাবে থাকে লুকোনো কুয়ো
একে ওপরের মধ্যে যেভাবে গোপন থাকে অবিশ্বাস

কখনো কখনো সেভাবেই থেকে যায় কেউ 
বাইরে থেকে বোঝাই যায় না  




অসময়   


সন্ধেবেলায় এলে
ঠিক যেন আয়নায় ধরা পড়ে গেছ
ছোটবেলা

খিদে পেয়েছে হয়ত 
কতদিনের জমিয়ে রাখা কথা
সহজেই 

তোমার খিদের সামনে 
জেগে উঠল আমার স্নেহ ও সন্তাপ 
অসময়ের ক্ষত




বিগ্রহ


ভিতরে সে মানুষ নয়
প্রখ্যাত, পাথরের ভাঙ্গাচোরা বিগ্রহ যেমন 
যাকেই পেয়েছে সামনে
ভেঙে ভেঙে, গড়ে গড়ে মনের মতো
ক্লান্ত এখন

আলো এসে সহজে পড়েছে ভিতরে
দেখেছে আশ্চর্য
অথচ সে মানুষ নয়
লোকে বলে 

বিগ্রহের মতো, ভাঙ্গাচোরা, পাথরের


তুমি ও বিষাদনিক্বণ 


১


প্রতিটি শোকের বুকে ছিপ ফেলে বসে আছে শোক 
কেউ বা সাঁতার মুখে জ্বেলে রাখে বিষাদ পূর্ণিমা 
কেউ বা হাওয়ায় একা অবকাশে চিঠির বাহক 
কান্নাকে কবুল করো হৃদয়েই পুঁতে যাবো সীমা 

শোকের বোধনলীলা আপাতত সাগরের দিক 
ভ্রাম্যমাণ সশরীরে উল্লসিত শঙ্খ সার সার 
কুড়িয়ে রেখেছি ব্যথামালা আর নৈঃশব্দ অধিক 
জতুগৃহে নিয়ে এসো স্বচ্ছ কিছু প্রণয়-শিকার 

লৌকিক ঝর্ণার নীচে মৃত স্বপ্ন, স্বপ্নের শরীর 
কে শুধু আবেগ-জলে দেহ থেকে তুলে নেয় রোগ 
ও লতা, আমায় বটবৃক্ষ ভেবে প্রেম করবে ধীর 
সমূহ গোলাপ ক্ষেত ব্যথা পেলে ফুটবে কি বিয়োগ 

ব্যথাকে আয়নায় ধরো যদি নামে অদৃষ্ট সংসার 
হৃদপিণ্ড হাতে তোলো, স্তব্ধ হও দেহ, নিরাকার 




২


হৃদপিণ্ড হাতে তোলো, স্তব্ধ হও দেহ, নিরাকার
কোথাও বিনম্রমেঘ দান করে ঊর্বশীয় জ্বর 
কোকিল ডেকেছে কুহু সামান্য মনের বিদ্ধদ্বার 
কুটি কুটি জানালায় দগ্ধ রক্ত, কেঁদেছে ঈশ্বর

গোপনে হৃদয় তুলে শিরা স্তরে বহমান জল 
একে কি শিশির বলি, যে ঘাসের মাথায় নেচেছে 
হে শূন্য, সন্দেহ! বাঁশি পরিচিত বাঁশুরির ছল 
ফুঁ দিয়ে বিস্তারে ঘাত গুহাময় শরীর এঁকেছে

সংস্কৃতি, স্নেহের প্রথা কোনো পাশে খাদ নেই, প্রিয় 
তোমার হৃদয়, দেবী নিয়ন্ত্রণে বিমূর্ত জীবন 
শঙ্খের সাঁতারে লোভ তবু, বধূ ঠোঁট আত্মক্রিয় 
স্থিরদৃষ্টি মোহমদ এ-শরীর মেনেছে হনন 

হৃদপিণ্ড হাতে তোলো, কেন সত্য, অস্বীকার করো 
শরীর সর্বদা বলিকাঠ, চায় প্রেম, ক্ষত আরও 




৩


শরীর সর্বদা বলিকাঠ, চায় প্রেম, ক্ষত আরও 
অঙ্গুরীর মূর্তস্থানে গোপনে ফুটেছে ব্যথাতারা 
হাঁদামুখী হত্যাকারী চাঁদ রূপতন্ত্রে জ্বালে কারো 
হৃদয়। নক্ষত্রযোগ দেখে বশীভূত এ-দোতারা 

নেউল জীবন চায়, রতি, ক্ষোভ, যুদ্ধের প্রস্তাব 
পরশ পাথর, তুমি কখনও-সখনও ছুঁয়ে যাও 
ফুসফুস, স্নায়ুঋষি, ভালোবাসি প্রতিকূলভাব 
মোহের দোহাই বৃন্দাবনে নয় হৃদয়ে কোপাও 

দেহ মাঝে ধোঁয়া ওঠে স্তরীভূত ছন্দের স্বভাব 
পাশাপাশি ভাগ করি শারীরিক যা কিছু বিয়োগ 
নেকড়ের মতো গর্জে মাটিবাহী চোখের বিভাব 
অশ্রুও উলঙ্গ প্রিয়,উদাসীন বেহায়াও এক 

তোমাকে দিয়েছি প্রেম, দগ্ধ বুক, বিশ্বাস-বেদনা 
তথাপি নসিব মেনে বুকে ধরব কখনও ছাড়ব না




৪


তথাপি নসিব মেনে বুকে ধরব কখনও ছাড়ব না
ফুসলিয়ে বাহুদ্বয়ে দুটি বুক ফোঁস দিতে দিতে
বিষ ঢালব উভয়ের ঠোঁটে জেগে উঠবে প্রিয় ওড়না
তার নীচে অস্তিত্ব ও এক আত্মা জন্মিবে ইঙ্গিতে

অনন্তে টাঙানো হবে ঝুমকো, চুম্বনের প্রতিচ্ছবি
ক্ষেতময় রাধিকার স্তনরাগ, ক্ষত চুঁইয়ে নামে
শরীর, পরমেশ্বর! বাঁচাবে এখন সুর যদি
তৎকালে তুমি জয়ী, প্রশমিত হবে, ধ্বংসে যাবে

তথাপি নসিব জানি যেটুকু গড়েছি নম্রমূর্তি
আমিও মাটির প্রেমী কেন এত বিক্ষত করেছি
নতুন মানবীছায়া তবু দাও ভ্রুণের আকৃতি
স্পর্শের দ্যোতনা, নেশা, পান করি আগ্নেয় চোখে কি?

অশ্রু, এক দিব্যনারী, সে আমাকে বাঁচাবে এখন
প্রেম ও ব্রহ্মের কাছে বিষাদ পাঠাব এতক্ষণ




৫


প্রেম ও ব্রহ্মের কাছে বিষাদ পাঠাব এতক্ষণ
উস্কানি ব্যতীত কিছু পীঠস্থান খোলা রাখে দেহ
সেখানে সংশয় ঝুলে পাখিজন্ম আমার জীবন
জোনাকি গর্ভের জলে আলোপুঞ্জ আর নষ্টস্নেহ 

কাচি বা চাকুর ধার, সহিষ্ণু সহ্যের প্রেমালাপ
কুচি কুচি রক্ত কণা নিমেষে প্লাবিত নগ্ন ব্যাধি
টেবিলে ল্যাম্পের স্নায়ু, মৃত প্রায় ধুকপুক শ্বাস
কলম ও খুলি চুপ, ও সখী, ও ব্রহ্ম, এসো সুধী

কবোষ্ণ হৃদয় কুঁজে বিহ্বলতা কে কত দেখেছি
কত জ্যোৎস্না! শান্ত চোখ! গড়িয়ে দিয়েছে অশ্রুহ্রদ
এ-হীন আঙুল, প্রিয় প্রতিচ্ছবি, সিঁথি রাঙিয়েছি
সমুদ্র বা সংঘর্ষের মাঝে ফেলে আসি চর্যাপদ

আমার বিষাদ, পান, যতই চিবোও, তত লাল
মরচের কুটিরে দেখি সন্দেহে সংশয়ে এ-আখ্যান




৬


মরচের কুটিরে দেখি সন্দেহে সংশয়ে এ-আখ্যান
শরীর, গুহার ন্যায়, যত জ্বালব চিঙ্গারির কণা
দেখো স্মৃতি, উস্কে ওঠো, শোনো মেয়ে স্নায়ুচিত্রগান
যদি বা হদিশ পাই, শুষ্কমুখ ধাতব অঙ্গনা

রন্ধ্রে রন্ধ্রে পালাব না, গড়ে দেবো অশ্রুর গহনা
এমন প্রপাতমুখে ভিজে চুল, জোয়ারের হৃদ
স্মৃতিকে আগুনে ফেললে মৃদু কাঁদে উল্কার মোহনা
কুঁড়ি ও স্মৃতির কাছে, তুমি শিশু, সারল্য অঙ্কিত

বিদগ্ধ গ্রামীণমূর্তি, সাড়হীন ধুতুরার টব
জাদুবিদ্যা, গৃহকাজকর্মহীন মেয়েটি তাকায়
সমস্ত স্মৃতির দায়, ফণা, বিষ, প্রেমের গৌরব
যে স্মৃতিতে প্রেম নেই মহৌষধ নিয়ে কেন যায়?

আর নয়, এ-দংশন পুষে রাখে সাপুড়িয়া মন
বিষ তুলি, রক্ত ওঠে, স্মৃতিও জিহ্বায় ঝলমল




৭


বিষ তুলি, রক্ত ওঠে, স্মৃতিও জিহ্বায় ঝলমল
ভিতরে, অনন্তে নড়ে দৃশ্যাতীত জ্যোৎস্নার ফুল
অবয়ব ফুটে ওঠে, লক্ষ্যে তুমি তৃপ্ত হও জল
পাথুরে চোখের নীচে, নেতিয়ে পড়েছে ব্রহ্মকূল

যে সূর্যের অস্ত নেই সে ভ্রান্ত আমার গোপবালা
উজ্জ্বল কবিতাবর্ণ দেহের গড়ন, ইঞ্চি মাঝে
সহজ শোক ও সুর নাভিস্থলে চিরপঙক্তিমালা
স্পষ্ট বা প্রতীকময়, মুগ্ধতাও ভণ্ড শিব সাজে

জীবন, দীঘির জল, আবছায়া হয় মৃদুপর
শুধু খুঁড়ে খাই পাঁকপদ্মস্তন। বিমূর্ত নারীটি
শত প্রতিমার মতো চেয়েছে যে সিঁদুর-আকর
এখন হৃদয় কুঞ্জে দ্ব্যর্থভাষা ফেরাও, অতিথি

মধুর ব্যতীত ভোমরা অচল রেখেছে যোগাযোগ
প্রতিটি শোকের বুকে ছিপ ফেলে বসে আছে শোক


সোনা জ্যাঠা



প্রতিদিন ঠিক সকাল আটটা নাগাদ সোনা জ্যাঠা আসতেন। কোনও বিরাম নেই। আমিও এইসময় ঘুম থেকে উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে খবরের কাগজ পড়তে বারান্দায় এসে বসতাম। সোনা জ্যাঠাকে দেখলেই আমার মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠে যেত। ভীষণ রাগ হত।
আমাদের বাড়ি থেকে জ্যাঠাদের বাড়ি তিন-চার মিনিটের পথ। জ্যাঠা-বড়মা আর জ্যাঠার বিধবা এক বোন থাকেন এক বাড়িতে। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি দোতলায় আলাদা থাকে। নীচতলার খরচখরচার ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা নেই। জ্যাঠার পেনশনের টাকায় সংসার চলে। খুব যে ভালোমতো চলে, তা বলা যায় না। কেননা জ্যাঠার তেমন কোনও রোগব্যাধি না-থাকলেও জ্যাঠিমা নানা রোগে ভোগেন সারাবছরই। সুগার, প্রেশার তো আছেই, সেইসঙ্গে বাতের ব্যথাতেও কাবু। জ্যাঠার বিধবা বোনকে আমরা ডাকি বুলা পিসি। সেই পিসিও খুব-একটা সুস্থ নন। সবমিলিয়ে জ্যাঠা যে পেনশন পান, তাতে ওষুধেই অনেক খরচ হয়ে যায়। এই টাকায় ঠিকমতো কুলিয়ে উঠতে পারেন না। ফলে খবরের কাগজের বাড়তি খরচ মানেই বিলসিতা। অথচ সোনা জ্যাঠার প্রতিদিন কাগজ পড়া চাই। দেশবিদেশের খবরের আদ্যপ্রান্ত জানা চাই। আমার ধারণা, সোনা জ্যাঠা কাগজের বিজ্ঞাপনগুলোও পড়ে ফেলতেন।
আমাদের কাগজ কেনার টাকা আমিই দিই। তাই আমি মনে করি, কাগজটা যখন-তখন পড়াটা আমার হক। অনেকটা আমার নিজের সম্পত্তির মতো। বাড়িতে সবাই জানে আমি যখন কাগজ পড়তে বসব, তখন কেউ সেই কাগজে হাত বাড়াবে না। হয় আগেই পড়ে নেবে, নয়তো আমার পড়া হলে পড়বে। কাগজের ভাঁজ নষ্ট হলেও চলবে না। বাবা তাই আমার পড়ার আগে কাগজ পড়েন না। ভাই কদাচিৎ আমার আগে কাগজ পড়তে নেয় বটে, তবে অতি সন্তর্পণে কাগজ খোলে আর পড়ে। সোনা জ্যাঠার এসবের বালাই ছিল না। আমি পড়ার আগে খবরের কাগজ নিতেন। উল্টেপাল্টে দেখতেন এবং পড়তেন। কাগজের ভাঁজ একেবারে নষ্ট হয়ে যেত। তাই আমার রাগ হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
একদিন বলেই বসলাম, আচ্ছা জ্যাঠা, তুমি একটু দেরিতে আসতে পারো না?
ক্যান? দেরিতে ক্যান? এইসময় আইলে কী হয়?
না, তেমন কিছু নয়। আসলে পরের দিকে এলে নিরিবিলি কাগজ পড়তে পারতে। এই যে আমি কাগজের ভেতরের পাতা চেয়ে নিই, এতে পড়ার ব্যাঘাত হয় না তোমার? সরাসরি বলতে পারছিলাম না বলে একটু ঘুরিয়ে বলতে চাইলাম। সহজ-সরল সোনা জ্যাঠার আমার ইঙ্গিত ধরতে পারার কথা নয়। 
নাহ্‍, তা হইব ক্যান? তুমিও এক লগে সব পাতা পড়ো না। আমিও পড়ি না। অসুবিধা কিছুই হয় না।
কিছুতেই যুক্তি সাজাতে পারছি না। আবার কাগজের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে, এটাও বলা যাচ্ছে না। বললেই হয়তো বলে বসবেন, কাগজের ভাঁজ নষ্ট হইলে কি ল্যাখা নষ্ট হয়? নাকি খবর উইড়া যায়? বলা তো যায় না। সোনা জ্যাঠা এইরকমই পালটা জবাব দেন। আমি যুক্তি হাতড়াতে থাকি। তার মধ্যেই সোনা জ্যাঠা বলে ওঠেন, পরের দিকে আইতে কইলা? ঐ সময় আমি ঠাকুরঘরে আহ্নিক করি। 
সেকি! এত দেরিতে? আহ্নিক তো ভোরে করতে হয়। 
হ, জানি। কিন্তু সবার সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা কইরা সময় পাল্টাইতে হইছে আরকি। 
কার সুবিধা-অসুবিধা? 
আহ্নিকের আগে ঘণ্টা বাজাইয়া ঠাকুর তোলা করি। সইন্ধ্যায় ঘণ্টা বাজাইয়া ঘুম পাড়াই তো, তাই ঘণ্টা বাজাইয়াই তোলা লাগে। এইডা নিয়ম কিনা জানি না, আমার বাবায় করতেন, তাই আমিও করি। তা ভোরে ঠাকুর তোলা করলে ঘণ্টার শব্দে পোলা আর পোলার বউয়ের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। নাতিরও অসুবিধা হয়। 
এইসব পারিবারিক জটিল ব্যাপারে আমি ঢুকতে চাইনি। তাই এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বললাম, তাহলে আহ্নিক শেষ করেই আসবে। তখন তো কাগজ এমনিই পড়ে থাকে। পড়তে পারবে একা একা। 
অ। তা খারাপ কও নাই। কিন্তু আহ্নিকের পরেপরেই নাতিরে লইয়া যাই বড় রাস্তার মোড়ে। অর ইস্কুলের গাড়ি আসে। অপেক্ষা করতে হয় সেইখানে। তারপরে তো ম্যালা কাজ। 
বয়স্ক মানুষের কী যে ম্যালা কাজ থাকে বুঝতে পারি না। কিন্তু যেটা বুঝেছি, সোনা জ্যাঠাকে এইসময় কাগজ পড়া থেকে বিরত করা যাবে না। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাই আমি। হাল কিছুতেই ছাড়ব না, এমন একটা রোখ চেপে যায় আমার। 
সবথেকে ভালো হয় জ্যাঠা, তুমি দুপুরে এসে বারান্দায় বসে কাগজ পড়তে পারো। একেবারে শুরু থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত। কথাটার মধ্যে শ্লেষ মিশে গেল, বুঝতে পারলাম। কিন্তু জ্যাঠা ধরতে পারলেন বলে মনে হল না। 
হ। সেই চ্যাষ্টাও করছি একদিন। দ্যাখলাম বউমায় সেইসময় কাগজ পড়ে। 
মা? মা কাগজ পড়ে জানি না তো! 
এইসব কি তোমারে বইল্যা করব নাকি? তোমার মা সংসারের সব কাজ সাইরা তয় কাগজ হাতে নেয়। 
এরপর আর কোনওদিন এইসব প্রসঙ্গ তুলিনি। ব্যাজার মুখ করে কাগজ পড়তাম আর মনে মনে গজগজ করতাম। একদিন সকালে সোনা জ্যাঠাকে দেখতে পাইনি বলে অবাক হলাম। অথচ আসেননি বলে ভালো লাগারই কথা ছিল। ব্যাপারটা সন্দেহজনক মনে হওয়ায় মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সোনা জ্যাঠা এসেছিল নাকি আজ? আমার মনে হচ্ছিল হয়তো সকাল সকালই কাগজ পড়ে চলে গেছেন। যদিও খবরের কাগজ পরিপাটিই ছিল। 
না তো। উনি আজ আসেননি এখনও। কয়টা বাজে? ওমা! সাড়ে আটটা বাজে। আজ কী হল ওনার কে জানে! মায়ের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ। 
আমার মায়ের সব ব্যাপারেই দুশ্চিন্তা! এসব আমার একদম ভালো লাগে না। যাক গে। এসব ভেবে আমি কী করব? নিজের মনে কাগজ পড়ে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ কাগজ পড়ে তারপর স্নান করতে যাই। ন-টার পরে স্নানে গেলে অফিসে যেতে দেরি হয়ে যায়। সেইসময় কানে ভেসে এল মায়ের কথা। বাবাকে বলছেন, দাদার একটু খোঁজ নিও তো। আজ পেপার পড়তে এলেন না কেন কে জানে! 
মায়ের আদিখ্যেতা দেখে রাগ হল খুব। একটা লোক পেপার পড়তে আসেননি বলে তাঁর খোঁজ নিতে হবে? রাগে গরগর করতে করতে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। 
অফিস যাওয়ার আগে দুটো স্লাইজ পাউরুটি খাই মাখন দিয়ে। ওপরে অল্প চিনি ছড়িয়ে দেন মা। স্লাইজে কামড় দেওয়ার সময়ই মার কথা যেন উড়ে এল কানে, যেভাবে কলপাড় থেকে উড়ে এসে পাতিকাকটা রান্নাঘরের জানালার ধারে এসে বসে। 
তুমি এক কাজ কোরো তো। একটু চুন-হলুদ গরম করে দিচ্ছি। দাদার পায়ে লাগানোর ব্যবস্থা কোরো। বুড়ো মানুষটা বাথরুমে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলেন! বুড়ো বয়সের ব্যথা কি সহজে যায়?
বাবা ইতিমধ্যেই সোনা জ্যাঠার খবর নিয়ে এসেছেন বুঝতে পারলাম। মা কথাটা বাবাকেই বলছিলেন। বাবাও মৃদুকণ্ঠে কিছু একটা বললেন। আমার কানে সেই শব্দ পৌঁছয়নি। রাগে আমার ভেতরে একটা আগুনের হলকার বয়ে যাওয়া টের পেয়েছিলাম। মুখ বুজে বেরিয়ে গেলাম অফিসে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে চা খাই শুধু। আর কিছু নয়। কেননা এরপর ক্লাবে যাব। সেখানে ক্যারাম খেলতে খেলতে এটা-সেটা খাওয়া হয়ে যায়। সেইসময় দেখলাম বাবা বেরোচ্ছেন। হাতে ব্যথানাশক মলম। 
কোথায় যাচ্ছ এটা নিয়ে? যদিও বুঝেই গিয়েছিলাম বাবার গন্তব্য। তবু একটু কথা শোনানোর সুযোগ পাব ভেবে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সকালের আদিখ্যেতা মনে পড়ে গিয়েছিল। এখনও একইরকম আছে দেখে মাথায় চড়চড় করে রাগ উঠে গিয়েছিল। বাবা মিনমিন করে বললেন, সোনাদার বাড়িতে যাচ্ছি। মলমটা দিয়ে আসি।  
তুমি দিয়ে আসতে যাবে কেন? ওদের বাড়ির পাশেই তো ওষুধের দোকান। বড়মা বা বুলা পিসিই তো টুক করে বেরিয়ে নিয়ে আসতে পারেন! 
তা পারেন। কিন্তু আমিই বৌদিকে বলেছি, আমাদের ঘরে একটা ভালো মলম আছে। কিনতে হবে না। বাবার গলা একেবারে খাদে নেমে গেছে তখন। 
তোমাদের সব তাতেই বাড়াবাড়ি। বিরক্ত মুখে বললাম আমি। মেজাজটা এত খিঁচড়ে গেল যে তক্ষুনি ক্লাবে বেরোতেও ইচ্ছে করছিল না। থম মেরে বসে রইলাম বারান্দায়। কিছুক্ষণ পরে ঘরের থমথমে পরিবেশ থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে বেরিয়ে গেলাম ক্লাবে।
পরের দিনও যথারীতি সোনা জ্যঠা আসতে পারেননি। আমি খবরের কাগজ পড়ছি। একটু বাদেই স্নান সেরে অফিসে চলে যাব। যাওয়ার আগে স্লাইজ পাউরুটি খাচ্ছিলাম প্রতিদিনের মতো। দাঁতে চিনির দান পড়ছে আর আমার ভেতরে ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ছে। সেইসময় ঘরের ভেতর থেকে মায়ের গলা শুনতে পেলাম। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু যেন বেশি জোরেই কথা বলছেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন লোকটা বিছানায় পড়ে আছেন। খুবই খারাপ লাগছে! 
কথাগুলো শুনে আবার আমার মেজাজ তিরিক্ষি হতে শুরু করেছে। মায়ের ধারাবিবরণী তখনও চলছেই। মানুষটার ঋণ কোনওদিন ভুলব না। তোমার তখন আগের কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল, চাকরি নেই অনেকদিন, উনি প্রায়ই কিছু কিছু চাল, ডাল, আলু ভর্তি ব্যাগ নিয়ে আসতেন। আরও অনেককিছু নিয়ে আসতেন হাতে করে। তুমি লজ্জায় মুখ নীচু করে থাকতে। আমি ঘোমটায় মুখ ঢেকে ওনার হাত থেকে সব জিনিস নিয়ে নিতাম। মাস তিনেক পরে তুমি নতুন চাকরি পেলে। আমি একদিন বললাম, উনি মাইনে পেলে আস্তে আস্তে সব শোধ করে দেবো দাদা। তা উনি জবাব দিলেন, সেই টাকায় তোমরা ভালোমন্দ খাইও বউমা। পারলে দুধ নিও একপো কইরা। তোমাগো চেহারা খুব খারাপ হইয়া গেছে। আমি যা করলাম, আমার ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের জন্য করছি। ও নিয়া তোমরা ভাইব্যো না। 
মা কি আমাকেই কথাগুলো শোনাতে চাইলেন? সোনা জ্যাঠা আমাদের একসময় অনেক উপকার করেছেন শুনতাম। কী উপকার জানার চেষ্টা করিনি। আমি জ্যাঠার ওপর বিরক্ত, সেটা কারও না-বোঝার কারণ নেই। তাই কি এতদিন পরে জ্যাঠার সেই অবদানের কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন মা? 
স্লাইজ পাঁউরুটি থেকে চিনি ঝরে পড়ল দু-এক টুকরো। অন্যমনস্কতায় এমন হল? তাড়াতাড়ি অফিস ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগে সোনা জ্যাঠার বাড়ি যেতে হবে। কাগজটা জ্যাঠার হাতে দিয়ে অফিসে চলে যাব। 
পরদিনই ১লা বৈশাখ। আমাদের অফিস ছুটি থাকে না। একটু আগেই স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম অফিস ব্যাগ নিয়ে। বাড়ির কাগজ সবার জন্য থকুক। নতুন কাগজ কিনে জ্যাঠার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেলাম। ফেরার পথে পেপারওয়ালা ছেলেটিকে বলে দিলাম, কাল থেকে জ্যাঠার বাড়িতেও পেপার দিও। মাসকাবারি দাম আমি দেবো।
এক প্যাকেট বড় মিষ্টির প্যাকেট সন্ধ্যাবেলায় জ্যাঠিমার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, সবাই মিলে খেও। সোনা জ্যাঠা বললেন, বাঁইচ্যা থাকো বাবা। অনেক বড় মনের মানুষ হও।  
ঠিক তখনই আমি বুকের ভেতরে একটা আবছায়া ছোট্ট বল গড়িয়ে যেতে দেখলাম। কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। ‘বড় মনের মানুষ হও!’ জ্যাঠার ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে রাস্তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আর সেই বলটার গড়িয়ে যাওয়া টের পাচ্ছিলাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে করতে পারছি না। চোখ পড়ল কোমরে হাত দিয়ে বড়মা দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে বুলা পিসি। দুজনেরই চোখ আমার দিকে। তাঁদের মাথার পেছনে আলো-আঁধারি গোলাকার বলয়ে আমার চোখ আটকে গেল। বলটা তখনও গড়িয়েই চলেছে।


অক্ষমতা 


যতবার তোমাকে আঘাত করেছি, সচেতন ভাবেই করেছি। অথচ পূর্ব পরিকল্পনায় ছিলনা কোন শূন্যের অহঙ্কার। প্রতিটি আঘাতে শক্ত হয়েছে হৃদয় তহবিল। আজলা ভরে নিয়েছি যা ফিরিয়ে দেইনি। সাদা পাতার বুকে কাটা কম্পাসের আঘাত বিদ্যমান। ঝুড়ি চাপা বন্দি পাখি, আগল ভেঙে পালাতে পারেনি। কুড়োতে পারেনি দ্বিধাহীন সামান্য উপহার। ছেঁড়া খাতা সেলাই করিনি আজও।

 বনময় ভেজা আলস্য এসে উকি মারে। আলোছায়ায় রহস্য আছে জানি। অথচ ভাবতে পারিনা কিছুই। আভাস এসেছে কিছু। ব্যার্থ হয়েছে গোল হয়ে বসার পরিকল্পনা। 

তবু তোমাকে ডিঙিয়ে এসেছে যে রোদ ছায়া ছায়া বেড়ে ওঠা আবোল তাবোল, তাকে আমি সম্মান করি 

স্বীকার করি না।




অস্থায়ী জীবনের শর্ত 


সম্ভাবনার বাসর সাজিয়ে পারদ ওঠানামা করছে।
তুমি চলে যাওয়ার আগে ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেলে
আমি আঘাত সরিয়ে পাইনি জীবনের হাতছানি 
জানি সময়ের অগোচরে উকি মারে ব্যর্থ জীবন 
জীবন তরঙ্গে তারা মাত্র অনাহূত জীব
প্রাচীন বিচারালযের ঝিমানো আসামী 
রাগ নেই ক্ষোভ নেই ভরসা নেই কোনো 

বেচে থাকার দুঃখ বাড়তে থাকে ফোটা ফোটা 
দিনের শুরুতে হাঁটুতে ভুমিকম্প নিয়ে কেপে ওঠে ছোটলোকের জাত

দেখতে দেখতে আমার সব অনুভূতি শেষ হয়ে যায় 

এবার অন্তত সরকারী বেসরকারি সমস্ত অস্থায়ী কর্মীবর্গ, 

আমি কল দিচ্ছি :

চলুন আমরা প্রকাশ্য রাজপথে চিৎকার করতে করতে প্রাণ হারাই।




স্পষ্ট 


ওরা আমাদের মাথা টিপ করে ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে। বোমার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছে। গলাটিপে ধরে ভিখিরি করেছে। প্রতিদিন আমাদের চিন্তা ভাবনা টিপে টিপে মারছে। ইচ্ছেমত নিজেদের কথা বানিয়ে বানিয়ে সাংবাদিকের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করাচ্ছে। আমার মেধাবী বন্ধু দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আমার মা বিনা বেতনে, খালি পেটে  রাস্তার নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্যাসের ব্যথায় মরছে। আমরা ওদের বিরুদ্ধে নাকি সপক্ষে বুঝে ওঠার আগেই, আনন্দবাজার ছবিতে ছবিতে ভরে যাচ্ছে শাসকের নারকীয় মুখে। আমরা আবার তা ধিন তা ধিন করে নেচে উঠছি অদৃশ্য তিনহাজার টাকার বিনিময়ে। পৌরসভা থেকে আমাদের বালতি দিয়েছে নোংরা পরিষ্কার করার জন্য। একটা বালতির বিনিময়ে স্পষ্ট করে বলে গেছে ভোট দিতে গেলে কান কেটে নেবে। কল্যাণী স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত মাষ্টার মশাই আর তার একমাত্র মেয়ের কাটা কান আমাদের ভয়ের একমাত্র কারন। তবু আমরা গাছ হয়ে কুঠারের হাতলের সপক্ষে স্পষ্ট উচ্চারণ করছি। 

আর পৃথিবী গোল প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।




শব্দ অচেনা শূন্য 


যে শিশু বসে আছে নিশ্চিত বর্গক্ষেত্র একে 
দিন বয়ে যায় ক্ষেত্রফল মেলে না 
শূন্যের রীতিতে বাঁধা যে দিকচক্রবাল 
তাকে ধরে কেবল মাতৃ জঠরে থাকা শিশু 
ঘরের ভেতরে ও বাইরে তার অন্ধকার আলো 
বোজা চোখে ধরা পরে যে ফুল 
তাকে ফোটাবে তুমি কোন অচেনা শরীরে 
ছায়াময় মায়াময় শরীর তোমার 
পুরেছে যে দিন 
সেইদিন হে প্রিয় ধরেছি এই হাত 

হাতচিহ্ন লেগে আছে মাথায় আমার




সর্বনাশ


জানি এবেলার তর্কাতর্কি ঘিরে বেধে যাবে কোলাহল। এখান থেকেই তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবে। তোমার ব্যাবহার করা শব্দে হানবে আঘাত। তবু যুক্তির পাহাড়ি পথে বসে থাকি নিরালায়। তোমার অযৌক্তিক জানালার গা বেয়ে ঝরে পড়ে মানুষ বিচ্ছেদের অনুবাদ। তবু আমি থেমে নেই। তুমি ছেড়ে গেলে, একে একে সব মিছিল আমাকে ছাড়িয়ে চলে যাবে জনতার উল্লাসে। 

এদিকে আমি ক্ষুধার্ত অসহায়, অধর্মের দানাপানি মুখে নিয়ে মুছে যাই সর্বনাশ।
তুমি এই সরল অঙ্ক বুঝবে না কোনদিন...




সৌন্দর্যতত্ত্ব


তোমার অপরুপবাদত্ত্ব পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা হতে দেবো না কখনোই
যেনো আমারও অধিকার আছে জলে ও নিষ্ফলে

এক প্রচন্ড বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমাদের
ছাড় পাবে না তুমিও হে রাজন

উড়ে যাবো এক নতুন গোলকে
যেখানে তোমার আমার স্পর্শের মধ্যে থাকবে
সামান্য খাদ্যের অধিকার
আর
নির্জনে বসে থাকা দূর সীমান্তে চেয়ে




আবেদনপত্র

ভাবনার আড়ালে দিন যাপনের গল্প জেগে আছে। একফালি পৃথিবী রুষ্ট হয় নি আজও। একটা ঝোপের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার দিন আজ। ভোরের ধ্যান মগ্ন স্তব্ধ কোলাহলের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চাই। তুমি এসেছ! হে সবুজ হে ভালো পাহাড়ে পাহাড় আমাকে নিয়ে যাও। আমার ঔদ্ধত্য আজ তোমার করতলে বিসর্জন দেবো। হে নির্দয় আমাকে কাঁদাও সর্বসান্ত করে দাও আমায়।

ইচ্ছে হলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে পারো। একবুক মেঘলা আকাশের গায়ে গা লাগিয়ে কপাল চাপড়াই। হে বৃক্ষনাথ আমার প্রিয়জনকে দেখিয়ে দিও না আমার স্বরুপ। আমি বড়ই লজ্জিত। মুখ দেখানোর মতো কিছুই নেই আমার।

তবু এই বনপ্রান্তে দুখঃসুখের চিরকালীন আবেদন ;
একটা ছোট্ট গাছের পাতা করে দাও আমায়।

তুচ্ছ মানুষ হয়ে তোমার সাথে আলাপ হওয়ার সব রাস্তাই আজ বন্ধ হয়ে গেছে।




বারোটা বাজতে দুই


বারোটা বাজতে আর মাত্র দুমিনিট বাকী। আর দুমিনিটে শেষ হয়ে যাবে দুনিয়াটা। শেষ হয়ে যাবে আদরের সন্তান। তার আগে শেষ কবিতা লিখে যেতে চাই। আজ জল ভরে রাখতে হবে গামলায়। শেষ মূহুর্তে কিছু মানুষ জলের জন্য হাপিত্যেশ করবে। এতদিনে মাত্র তিনটে গাছ লাগিয়েছি। দুটো বড়ো হয়ে গেছে, একটা আম গাছ এখনও ডানা মেলতে পারেনি। এই বিপুল মানুষের বুকে তারা অক্সিজেন দিতে পারবেনা। তারা নির্বাক নিস্তব্ধ। বড়ো মুষরে পরেছে আজ। আমাকে অবিরাম দোষারোপ করছে। মুখ তুলে কথা বলতে বারণ করেছে। কান পাতলে শুনতে পাচ্ছি মাটি চাপা জলের আর্তনাদ। কি ভীষণ হাহাকার তাদের। একটু একটু করে মাথার ভিতরে গাছের শিকড় ঢুকে যাচ্ছে। আমি অ্যালুমিনিয়ামের তার পাওয়ার নেশায়, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে উন্মত্ত হয়ে ভেঙেছি পাখির বাসা। ইঁদুরের লেজে সুতো বেঁধে ত্রিভুবন দেখিয়েছি। একটা একটা করে ফড়িংয়ের পাখনা ছিঁড়েছি। উপভোগ করেছি তার ল্যাংড়ানো।

শেষ করে দেওয়ার খেলায় আমিই প্রথম।
আমি পুরস্কার পাবো। তোমরা একটু প্রচার করো।
শেষের সেদিন আমি পুরস্কার আনতে যাবো।

হাততালি দিয়ে উৎসাহিত কোরো আমায়




আদাব


এখনই তোমাকে কাঁদানোর সময়। জানি তোমার চোখের জলে আমার লিকলিকে আম গাছে নতুন পাতা জন্মাবে। সেই ভোর রাত থেকে আমার অবাধ্যতা সহ্য করতে হয়েছে তোমাকে। আমার অসহ্য জীবনের নৌকা ডুবে যাচ্ছে। জলের ইতিহাস সহজ কথায় লিখে রেখে যাবো। গাছের অস্বাভাবিক মৃত্যু লিখে রেখে যাবো। অর্থহীন এইসব প্রলাপ বুকে মতবিরোধ তীব্র হবে। শিশু মৃত্যুর পরিসংখ্যান পালকের মতো সুড়সুড়ি দেবে মুখে। একদিন তোমার টাকার বাগানে মৃত শিশুর স্তুপ দেখে, একটু গা শিরশির করে উঠবে। আজ ঝড় উঠতে পারে। খাবার চেয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হতে পারে। সত্তর বছর ধরে দেখছি ক্ষুধার্ত শিশুর বুকে দাড়িয়ে পালোয়ান প্রধানমন্ত্রী। হে প্রধানমন্ত্রী আমার সহনাগরীক বুদ্ধিমান এবং বোকাচোদা টাকার মালিক। আদাব জানাই তোমাদের।


 

বৃক্ষমানব


গাছের সাথে রক্তমাংসের বন্ধু আলাদা করা গেল না। এই প্রবল গরমে বন্ধু-কুয়াশা গায়ে মেখে নেওয়া যায়। একা চিঠি ইথার তরঙ্গে, ওরে মেঘদূত ওরে প্রাণ হন্তারক ভাসানোর আগে ভাবো। ভেবে ভেবে নতুন নাম দেওয়া চাই। নাম ঘোষনার আগেই সাদা ধবধবে পাতায় রঙচঙে পুরস্কার। কে হাততালি দেবে আজ! জলের বুকের থেকে শ্যাওলা আলগা হয়ে যাবে! জানি বুকের নোনাজল ক্রমশ ধারালো হচ্ছে। গুছিয়ে বলতে শেখার আগেই পরোতে পরোতে সাজিয়ে রেখেছো প্রত্যাশা পুরনের আশ্চর্য চাবি। ছলে বলে খুলে দাও জাগতিক দরজা অসীম। পাতায় পাতায় পড়ে থাকি আমি, আর তুমি আশ্চর্য অকারণ সাহসী মেজাজ। আর সব অশরীরী প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী নাম। যেখানে দশ লক্ষ প্রাণের আকুতি আমাদের নাম ধরে ডাকে! গুছিয়ে বলেনি সাজাতে জানে না। জানে না অদৃশ্য প্যাচ পয়জার। দানবীয় ভালোবাসা এলোমেলো ছরানো ছিটানো সমবায় সরল সমিতি। পন্ডিতগন এসবের কিছুই বোঝেনা। গোছা গোছা বই নিয়ে থম মেরে থাকে আর উই ধরে মাথায় তাহার।

আমরা আক্রান্ত হই জংলী ফুলের গন্ধে কমল বাবুর বাসার আশায়।


দেবী


নিরঞ্জনের কিনারা ঘেঁষে রোগা এক একলা বাঘিনী
রঙের ধারাটি বয়ে যায়, কোলকুঁজো। ধুয়ে যাচ্ছে মাটি
উড়ে যাচ্ছে পরানদোতরা। প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরে যা বলেছিলেন দেবী
ধান্য পুষ্প আর দুগ্ধবতী গাভীকুল – অথই গেরস্তি

সরিয়ে রেখেছে কবি তার উপমা-তূণীর, ব্যাসকূট 

দেবীর চোখের জল -- শুধু এক নদী পাতা আছে




আগুন


ঘন্টা বাজে গুমঘরে চামড়ার তালবাদ্য
হাড় মুখে তুলে নিয়ে উড়ে যায় প্রমিত শকুন
আজ কি ছুটির দিন তুরপুনে বিঁধে যায়
নিঃসঙ্গ বেলুন এক চুপসে রয়েছে একা একা
এ পাহাড়ে খুলিগুহা এ কঙ্কাল বালুকালাঞ্ছিত

ছাই জমে চরাচরে, অগ্নিবর্ণ গাছটির মন




চণ্ডস্বর


পত্রমোচনের দিন প্রমত্ত শিখাটি তবে জ্বেলে দিই
লবঙ্গ বনের মাঝে সে এক মন্দির, পাশে তার অগাধ দীর্ঘিকা

জলের ভেতরে ওই কার মুখ দেখি আমি

আমি কি মাংসভুক আমি কি নিজেই কেটেছি এই শিরা
করতলে এত রক্ত এত এত হায়নার ডাক

চণ্ডস্বর বেজে বেজে একা একাই পাক খাচ্ছে নিহিত সুড়ঙ্গে




বরাহ-অবতার


ভাঙো জরা ভাঙো জন্ম এই সুড়ঙ্গ আদিমাতৃকা
গভীর টানেল জুড়ে স্ট্যালাকটাইট, নুন-গাছ
নামিয়ে রেখেছে ঝুরি প্রেত আর প্রেতিনীর মেটিং সিজন

ধুনি জ্বেলে অপেক্ষার পরপারে লব্ধ জন্মসূত্র

গুঁড়ি মেরে আসে চিতাবাঘ
ধায় শব্দ ধায় বজ্র জেগে উঠছেন বরাহ-অবতার




বালুকাময় হাত


চতুর্মুখে ছুটছে আগুন; মুণ্ড নিয়ে লোফালুফি খেলা
সমুদ্র-চামড়া ছিঁড়ে উঠে আসে কমলে-কামিনী

ওলো তোরা শাঁখ বাজা উলুধ্বনিতে ভিজে যাক পাড়া
সতীচ্ছেদ ছিন্ন আজ নতমুখে বসেছে ধরণি
নম যন্ত্র নম যন্ত্র পণ্যবিলাসী এক হাঁক দিয়ে যায়
আমার পূজার থালা উপচে উঠছে রক্ত মজ্জা হাড়ে

ভেতরে বাহিরে শুধু কড়া নাড়ে একটি  বালুকাময় হাত



ঈদ মোবারক


*

একবার হায়দার ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত পেয়েছিলাম। বাপিকে বলতেই এক ধমকে দাওয়াত খাওয়া 'ছুটিয়ে' দিয়েছিলেন! লাচ্চা নাকি গরুর তেল দিয়ে বানানো হয়। 'ঈদের দিন রান্না-বান্না কি কেউ তোমার জন্য আলাদা করে করবে?' —রাগে চোখ-মুখ লাল করে বলেছিলেন। 

আমার আর যাওয়া হয় নাই। হায়দার ভাই মন খারাপ করেছিলেন কি না জানি না। হায়দার ভাই মারা গেছেন।

*
একবার ছোটকাকার এক বন্ধু ওসমান কাকার বাসায় ছোটকাকার হাত ধরে গিয়েছিলাম দাওয়াত খেতে। সেটা রোজার ঈদেরই দাওয়াত ছিলো যতদূর মনে পড়ে। ওসমান কাকার বাবাকে সবাই ডাকতো সদরপাগলা। বহুদিন পর্যন্ত আমরা ছোটরাও জানতাম তার নামই সদরপাগলা! একদিন কোনো এক গভীর শীতের রাতে সদরপাগলা ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। জনশ্রুতি আছে মাঠপাড়া দওয়ে সেই শীতের রাতে সদরপাগলাকে উত্তর পাড়ার জালাল সেখ ডুব দিতে দেখেছেন কিন্তু উঠতে দেখেন নাই! সেই থেকে সদরপাগলা নিখোঁজ! 

ওসমান কাকার বাড়িতেই সেবার দুধের পিঠা খেতে নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম— দুধের পিঠা লবণ দিয়েও বানানো যায়।

*
ঘটা করে মনে নেই একা একা ঠিক কবে ঈদের দাওয়াত খেতে গেছি বন্ধুদের বাসায়। হুট করে ঠিক কবে বড় হয়ে গেছি। শুধু মনে পড়ে একবার ঈদের দিনে নামাজ ফেরৎ বন্ধুর মাথার টুপি মাথায় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। মিলন ডাক্তার দূর থেকে তার ডিস্পেঞ্চারিতে ডেকে নিয়ে, ভয়েস চেপে রেখে কড়া করে বলেছিলেন, 'হিন্দুর বাচ্চা মোল্লাগোরে টুপি পইড়া ঘুরতে শরম করে না?? খোল্!' 

টুপি বা দাড়ি মোল্লাদের কওলা করা জিনিস এমন কথা শুনে নিঃশব্দে হেসেছিলাম সেদিন। 

একদিন রুমু ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে দেখি দাওয়াত করেও হিন্দুদের জন্য তেমন কোনো ব্যাবস্থাই রাখে নাই। সেমাই খেতে দিয়ে ভাত-মাংস খাওয়ার আদর করতে করতে চাচী মৃদূ হেসে বলেছিলেন, 'মোনো ডাক্তারের ব্যাটা হিটলার তো খায়। খাও, কিছু হোবো না।' 

*
মনে আছে, ঈদ উপলক্ষ্যে একবার আমাকে একটা টকটকে লাল শার্ট উপহার দিয়েছিলেন রানী আপা। সকাল সকাল স্নান করিয়ে সেই শার্ট পড়িয়ে, বাম হাতে মুখ ধরে রেখে ডান হাতে চুলে চিড়ুনি করে দিতে দিতে বলেছিলেন, 'তোর বউ হইক আগে। তখন যদি ব্যাচা থাকি তা'লে তাক একবার জিজ্ঞাস করমু এই রকম জংলি ব্যাটার সাথে ঘর কইরতে কি রকম লাগে? বউ থ্যাকপোনা ছ্যারা তোর!' 

তারপর ভাতৃবাৎসল্যে পরম মমতায় মুখে সেমাই তুলে খাইয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে সেই এঁটো সেমাই খেয়েই তার নিজের ঈদ শুরু করেছিলেন।

*
সকলের ঈদ আনন্দময় হোক।


হাইকু সনেট-১


হাওয়া এলে
ঝরাপাতার দল
গান শোনায়...

রোদের ওম্
ছায়া আবছায়ায়
ব্যাকগ্রাউন্ড...

নদীর জল
ছলকে ওঠা ঢেউ
স্বরলিপি...

ধুলোর পথ
সুরের কণাগুলি
উড়িয়ে দেয়...

আমার মন কবে
এমন সুরে গান...




তিনটি কবিতা

১.

শব্দ যদি
রিক্ত ভাবনায়--
রক্তবীজ...


২.

পলল চাঁদ
রক্তমাখা রুটি
বর্তমানেষু!


৩.

ঈশ্বর তো মৃত
আমার দিন 
আয়াত পড়ে কাঁদে...




হাইকু সনেট -২


দূরের পথ  
হেঁটেই সামলাও
হো সাবধান

মুঠির জোর 
আলগা হয়ে যায়
খাবার নেই

পায়ের নীচ
ঝলসে উঠছেই
হেই সামাল

শিশুর মুখ
কান্না ফেলে দেয়
বেবাক ঘোর

বুকে বাঁচার ওম
পাথর পেরোবেই...




আলাপ


শব্দাতীত
বজ্রপাত হোক
দেহের অবসানে

রমণ সুখ?
বিহগ উন্মুখ
স্পর্শাতীত গানে।

বাদর মেঘ
তুমুল জল মেখে
ডাহুক সামলায়

এবার সব
যত অসম্ভব
রাগিনী মেখলায়

সবিস্তার আলাপ শুরু হল...


পাঁচটি কবিতা


১.


জোনাকির ব্যাকুলতাই ---- আলো ।

একদিন এ ছোট্ট অনুভব, মনের মধ্যে যেন
          বলেই পালালো ...

জীবনও তো এ রকম, আমাকে জানিয়ে দেয় কোনো সন্ধ্যাকালে
     আমরাও তো আলো হতে পারি
     আরও একটি অনুভবের বাড়ি ।

এরকম ব্যাকুলতা ভালো ।

চুপ করে বসে থেকে দিগন্ত মাখিয়ে ভাবি---- 
      জোনাকির ব্যাকুলতাই আলো ! 




২.


তুমি এসেছ, আর আমার মনে পড়ল পাখির কথা
ডানায় ডানায় যাওয়া... 

থাক,ব'সো ওই আসনটায়, ওই যে
         কালিলাগা হেরিকেনের পাশে

কতদিন পরে যে এলে
"মাধবীবিতান মাধবীবিতান" ব'লে আর আমি
      ছুটে ছুটে বেড়াই না ।

জানো, এতদিনে আমি বুঝেছি যে
একটা কবিতা হাত নেড়ে আর একটা কবিতাকে ডাকে
আজ তোমাকে বলছি, কবিতা  পিঠে টোক্কাও মারে ... 

পাখির কথা মনে হচ্ছে এইসব কথার তলায় -তলায়
ডানা ওপর-নীচ করছে ... 
হাওয়া হচ্ছে... 
উড়ে যাচ্ছে ... যাচ্ছে ... তোমার থেকে দূরে... 

তুমি তখন মাটিতে দাঁড়িয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে
একসময় বলে উঠবে,"ওমা! যাহ্ ! চলে গেল ! " 

চলে-যাওয়া দিয়েই তো পাখি তৈরি ।




৩.


জানি, অলি তুমি ----- পছন্দ করছ না
লেখা লাথি মারো, গান লাথি মারো --- বোশেখে
হা হা দিন যায় অবহেলিতের ফাটকায়...
তবু দ্যাখো দেখি, কবিতার মতো ব'সে কে?

মৃত্যু কি বসে?...ভুরু কুঁচকিয়ে উঠলে ।
স্টোভের মধ্যে গুঁজলে গোপন চুম্বন ।
অলি, স্থির থাকো ।... গান হবে ভাত ফুটলে ।
সেই গানগুলি আমরা দুজনে শুনব ।

জানি, অলি তুমি ---- পছন্দ করছ না ‌।
মৃত্যু ধরিয়ে সাপের পেছনে ছুটেছি...
কিন্তু--- পাইনি । শুধু হিসহিস । সাপ নেই ! 
লিখি, আমি লিখি... লিখে লিখে রাখি স্বপ্নে ।

অলি এতদিন!... শোনো চার যুগ ধ'রে
লিখেছি, তুমি তা জানতে !
অবসাদ এসে লেখার মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বলো ?

জানি , এগুলিও পছন্দ করছ না 
একদিন দেখো মৃত্যু বসাবো দু'জনের পদপ্রান্তে।




৪.


সালার প্যাসেঞ্জার থেকে যে-মেয়েটি নেমে এলো জাস্ট
তাকে আমি মাউথ অর্গান খানি দেব

সে তাকে বাজাবে কি না সঠিক জানিনা
হয়তো সে বাজাবে না; মুখটি ফিরিয়ে নিয়ে
তাকিয়ে থাকবে শুধু কাটোয়ার দিকে
সেখানে একটি ছেলে , হয়তো তখনই 
গঙ্গার পাড় ধরে হেঁটে যায় তাকে মনে ক'রে 

কিছুতেই বাজাবে না, তবুও মাউথ---অর্গান
হাতে দিয়ে বলে দেব---
     "দিলাম । কখনও এক রাত্রিবেলা ব'সে
ধীরে ধীরে সুর তুলে একবার রক্তপাত ক'রো
দেখবে, যুবতী হবে পুরো 

মেয়েটি এগিয়ে এসে ---- ফের ঘুরে উঠে গেল
সালারের ট্রেনে...



৫.


বুড়িদের বাড়িকে বাঁয়ে ফেলে
ইলাদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে এলাম
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম ইবনবতুতার কথা
ভাবছিলাম ফা-হিয়েন কেমন ভাবে হেঁটে ঘুরতেন

তবে বাড়িতে এসে পা ধুতে খুব দেরি হয়ে যায়
খুব ভালো করে ধুই ।

কচলে কচলে, সাবান দিয়ে, জলের ধারায় ।
তবু খচখচ করে, ধুলো লেগে নেই তো ! 

একদিন ধুতে ধুতে দেখি
আমার পা একেবারে অন্যরকম দেখতে হয়ে গেছে
হলফ করে বলতে পারি---- এ আমার পা নয় ... 

তাহলে কী হলো !
কার পা আমার হয়ে উঠল একদিন !
Subscribe to: Posts ( Atom )

LATEST POSTS

  • সাক্ষাৎকার : কথাসাহিত্যিক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় • কথোপকথনে সোহম চক্রবর্তী
    প্রাক্ সম্ভাষণ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশক একজন কথাকার তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিটি লেখাতেই কথা বলে একেবারে স্বতন্ত্র ও...
  • অপ্রকাশিত কবিতাগুচ্ছ - বিমান মাহাতো
    ভোট কষ্ট করে একটা কথা ছাপাও তোমরা, একটু খোলো ছদ্মবেশ। হাজার হাজার প্রহর কাটে অসুখী আর আমাদের সব প্রতীক্ষা শেষ। শেষ হয় না জীবন, ...
  • কবিতা : শীর্ষা
    নদী নদীর কথা ভাবলেই আমার চোখে তোমার গালের শিরাটা ফুটে ওঠে কী অসম্ভব বাঁশির মোহন কী অসম্ভব বয়ে যাওয়া ! ফুলেল স্রোতে টালমা...
  • কবিতা : সোহম চক্রবর্তী
    আমি নয়, আমার কবিতা যা-কিছু অসম্ভব, তা-ই আমি কবিতায় লিখি আমি না-হ’লেও আমার কবিতা বাজারে যায়, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাসিঠাট্টা করে, পু...
  • কবিতা : বেণীমাধব ঘোষ
    স্টিমুলাস            এসো এই মৃত্যূপুরীতে দাঁড়িয়ে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হই ঠোঁটে ঠোঁট, হালকা আবেশে বুজে আসা চোখ তিন গজ দূর থেকে...
  • কবিতা : রণজিৎ অধিকারী
    উষ্ণতা ও কম্পন বিষয়ক কবিতা   একটি আলিঙ্গনের আয়ু আলিঙ্গন শেষ হওয়ার আগেই ফুরিয়ে যায়।  কজনইবা জানে অর্গাজমে যোনি কেঁপে ক্রমে স্থি...
  • কবিতা : জয়ীতা ব্যানার্জী
    তিন পঙক্তির কবিতাগুচ্ছ                   অশ্রু এত স্বচ্ছ, নিরুত্তাপ। তবু কেন ক্রোধ বেঁধে রাখো কৃষ্ণনামে আলো দাও স...
  • কবিতা : চন্দ্রনাথ শেঠ
    ঠোঁট ভেজাবে চুমা ফোনের এপারে কান্না ওপারেও। মাঝখানে ছোট  নদী। ভেসেছে নৌকা। কাগজের। লেখা : 'ভালো থেকো ভালো রেখো...' ...
  • কবিতা : গৌরব চক্রবর্তী
    মেঘ ও শ্রীমতী চুম্বন  ১. আমি তো পরাগে তাকে ঢালি তাকে আমি ঢালি খোলা মদে কত পাখ্ কত যে পাখালি উড়ে আসে সোনার গারদে  এক...
  • শম্ভু রক্ষিত স্মরণে : চন্দ্রদীপা সেনশর্মা
    আ জ সকাল কবি শম্ভু রক্ষিতের মৃত্যুর খবর নিয়ে এলো। তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকবছর। তাঁর মৃত্যুর প্রস্তুতি কমবেশি আমাদের ভিতর গড়ে উঠেছ...

Categories

  • অচিন্ত্য মাজী
  • অনিন্দ্য রায়
  • অনিমেষ মণ্ডল
  • অপাংশু দেবনাথ
  • অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
  • অমিতাভ দাস
  • অমৃতাভ দে
  • অরিত্র চ্যাটার্জি
  • অরিত্র সোম
  • অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায়
  • অরুণ পাঠক
  • অলোক বিশ্বাস
  • আবুল হাশিম
  • আলিহান্দ্রা পিজারনিক
  • উজ্জ্বল ঘোষ
  • উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়
  • উমাপদ কর
  • কেনেথ হোয়াটস
  • কৌশিক চক্রবর্তী
  • গৌতম মণ্ডল
  • গৌতম সাহা
  • গৌরব চক্রবর্তী
  • চন্দ্রদীপা সেনশর্মা
  • চন্দ্রনাথ শেঠ
  • জয়ীতা ব্যানার্জী
  • জুয়েল মাজহার
  • তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায়
  • তৃণা চক্রবর্তী
  • দিমিত্রিস লিয়াকস
  • দিশারী মুখোপাধ্যায়
  • দীপক রায়
  • দেবজ্যোতি রায়
  • দেবদাস আচার্য
  • দেবাশিস চন্দ
  • দেবাশিস সাহা
  • নাফিস আনোয়ার
  • পঙ্কজ চক্রবর্তী
  • পঙ্কজকুমার বড়াল
  • পার্থজিৎ চন্দ
  • পার্থপ্রতিম মজুমদার
  • পিন্টু পাল
  • পিয়াস মজিদ
  • প্রজিত জানা
  • প্রতাপ মুখোপাধ্যায়
  • প্রতাপ হালদার
  • প্রদীপ চক্রবর্তী
  • প্রদীপ সিংহ
  • প্রশান্ত মাজী
  • প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী
  • প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ
  • বঙ্কিম কুমার বর্মণ
  • বিজয় সিংহ
  • বিধান সাহা
  • বিপাশা ভট্টাচার্য
  • বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
  • বিমান মাহাতো
  • বিশ্বজিৎ দাস
  • বিশ্বজিৎ মাহাত
  • বেণীমাধব ঘোষ
  • মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
  • মনোজ দে
  • মলয় গোস্বামী
  • মহুয়া বৈদ্য
  • মারুফ আহমেদ নয়ন
  • মৌমিতা পাল
  • যুগান্তর মিত্র
  • রজতকান্তি সিংহচৌধুরী
  • রঞ্জন ভট্টাচার্য
  • রঞ্জন মৈত্র
  • রণজিৎ অধিকারী
  • রাজীব পাল
  • রাশেদুন্নবী সবুজ
  • রিমি দে
  • রুদ্র কিংশুক
  • শান্তনু দাস
  • শীর্ষা
  • শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
  • শুভাশিস মণ্ডল
  • সঞ্চারী ভৌমিক
  • সঞ্জয় সাহা
  • সন্তু কর
  • সমরেশ মুখোপাধ্যায়
  • সমীরণ ঘোষ
  • সাক্ষাৎকার
  • সাম্য রাইয়ান
  • সায়ন রায়
  • সায়ন্তনী হোড়
  • সুকুমার মণ্ডল
  • সুজিত মান্না
  • সুদীপ ঘোষাল
  • সুদীপ চট্টোপাধ্যায়
  • সুদেব বকসী
  • সুবীর সরকার
  • সুব্রত পাল
  • সুমনা দত্ত
  • সুমিত মণ্ডল
  • সোমেন মুখোপাধ্যায়
  • সোহম চক্রবর্তী
  • সৌমনা দাশগুপ্ত
  • সৌমাভ
  • স্নেহাশিস রায়
  • হিন্দোল ভট্টাচার্য
  • হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

Blog Archive

  • September (1)
  • July (27)
  • June (18)
  • May (60)
Powered by Blogger.

ANNOUNCEMENT

Aloprithibi is a monthly blog of poetry and prose about poetry. The editorial board is not responsible for the content and interviews published on the blog. Absolutely the personal opinion of the author and narrator. No reprint of this blog may be published without the permission of the editor and sub-editor. Otherwise it will be dropped under copyright law.
Copyright 2014 আলোপৃথিবী .
Designed by OddThemes