শম্ভু রক্ষিত স্মরণে : চন্দ্রদীপা সেনশর্মা



জ সকাল কবি শম্ভু রক্ষিতের মৃত্যুর খবর নিয়ে এলো। তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকবছর। তাঁর মৃত্যুর প্রস্তুতি কমবেশি আমাদের ভিতর গড়ে উঠেছিল। শুধু একটি ঘোষিত দিনের নাম জুড়ে গেল, এই যা। আমার কাছে তিনি পিতৃসম। সেসব ব্যক্তিগত কথা এখন থাক। তাঁর কবিতার আমি যে একজন পাঠক, আর তিনি এক আশ্চর্য মহাপৃথিবী নির্মাণ করে গেলেন আমার মতো অনেক পাঠকের জন্য এটুকুই আমাদের গর্ব আনন্দ শান্তি।



চিত্র ঋণ : লিটল প্রচার লিটল প্রসার ফেসবুক গ্রুপ

কবিতাকে শম্ভু রক্ষিত বস্তুত মাথায় নিয়ে চলতেন। তাঁর মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া কাগজ কলেজস্ট্রিট থেকে মেদিনীপুরে বিরিঞ্চিবেড়িয়ায় পৌঁছত। সবার লেখা ঘুরে ঘুরে তিনি জোগাড় করতেন। কম্পোজ থেকে শুরু করে, ট্রেডল মেশিনে ছাপা সব কাজ নিজে করে তাঁর আয়তনে ছোট কিন্তু প্রকৃত ওজনদার পত্রিকা 'মহাপৃথিবী' প্রকাশ করে গেছেন বছরের পর বছর। দুহাজার আঠারোতেও তিনি গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন বিখ্যাত সব কবি লেখকদের ঠিকানা। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে দুহাজার এগারোর পর তাঁর বাড়িতে তাঁকে দেখতে যাওয়া সেই প্রথম।


দুর্গাপুরে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে কবি


চন্দ্রদীপা সেনশর্মা'র সঙ্গে কবি শম্ভু রক্ষিত


নিজের সম্পাদিত পত্রিকা 'মহাপৃথিবী' পড়ছেন

জরুরি অবস্থার সময় শম্ভু রক্ষিত জেল খেটেছিলেন এবং পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। যে-ক'জন বাঙালি সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি তাঁদের একজন। এমনকি কবি কালীকৃষ্ণ গুহ মনে করেন, তাঁদের প্রত্যেকের হয়ে শম্ভু রক্ষিত নৈতিক প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। অথচ এ নিয়ে তিনি নিস্পৃহ ছিলেন। বস্তুত তাঁর কোনো দাবি ছিল না পরবর্তী সরকার বা কোনো সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের কাছে।


১৯৭৫ এর জরুরি অবস্থা প্রসঙ্গে কবির মন্তব্য
শম্ভু রক্ষিতের সাক্ষাৎকারের অংশ
চিত্র ঋণ : কবিসম্মেলন পত্রিকা ও ফিনিক্স পত্রিকা


তরুণ বয়সে কবি শম্ভু রক্ষিত
চিত্র ঋণ : সুব্রত পাল

শম্ভু রক্ষিতের লেখা নিয়ে বলার মতো অনেকেই আছেন, বলেছেন। আমি কেউ না। তাঁর কবিতা তাঁর নিজস্ব ধ্বনি স্বরে স্বতন্ত্র! মাইক্রো জগত থেকে ম্যাক্রো ভলিউমে পৌঁছে যায় অতি অনায়াসে। তাঁর দ্বিতীয় বই 'প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না' আজও বিস্ময়ের! তিনি ধ্বনি এবং বাক এই দুইয়ে ভর করে তাঁর ঈশ্বরকন্যাকে প্রতিষ্ঠা দিলেন। এ যেন ঋতবানের আরাধনা বাক দেবী বা ব্রহ্মণের। তাঁর উচ্চারণের অভিনবতা মুগ্ধ করল আমাদের।


দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ
প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৩
দ্বিতীয় প্রকাশ : ২০০২
তৃতীয় পরিমার্জিত প্রকাশ : ২০১৮


সপ্তম কাব্যগ্রন্থ
প্রথম প্রকাশ : ২০০৪


প্রথম প্রকাশ : ২০০৫
দ্বিতীয় পরিবর্ধিত প্রকাশ : ২০১৫
প্রকাশক : দি সী বুক এজেন্সি

এই বইয়ের আশ্চর্য পঙক্তি : 

'তুমি ঈশ্বরকন্যা, তুমি আমাকে বিশুদ্ধ কবির জনক হতে সেদিন শেখালে
ব্যক্তিগত মৌলিক দৃশ্য থেকে ধূসর বিষয় নিয়ে আমি, ব্যক্ত অব্যক্তের
অবাস্তব মুহূর্তের স্বতন্ত্র আমি, আমার গভীরতর সাম্রাজ্যে
তুমি আছো, তুমি নেই ...' (১)

'কতদিন তোমাকে দেখিনি, তাই পুঁথি পড়ে সন্দীপনি মুনির নিকট
অবন্তীনগরে বসে থাকি; ...' (৭৮)

'আচমকা এক ঝাঁকানি খেয়ে চলে আসব আমি আমার কাছে, অদ্ভুত এক
রহস্যময় রোগে মারা যাব আমি ---' (৯৯)

কবি কি সত্যদ্রষ্টা ঋষির মতো জানতেন?
এই সর্গের শেষে তিনি লিখেছেন : 

'মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবীর বাকি অন্ধকার ও শৈত্য জ্বলে উঠবে
বৃষ্টি কুয়াশা নিয়ে আমার শরীর জেগে উঠবে'

এই লেখার কাছে নতজানু হলাম আমরা।


মহাপৃথিবীর পুরোনো একটি সংখ্যা
চিত্র ঋণ : পৃথ্বী বসু


মহাপৃথিবীর ৫০ বর্ষপূর্তি উদযাপন সংখ্যা
এটিই মহাপৃথিবীর শেষ প্রকাশিত সংখ্যা
চিত্র ঋণ : দীনেশ কর

প্রতিটি মৃত্যুই শোকের, কিন্তু প্রতীক্ষিত। আজ চারপাশে মৃত্যুর হাহাকার। পৃথিবীর এই ঘোর দুর্দিনে কবি শম্ভু রক্ষিত চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যু বা জীবন ঘিরে নেই কোনো স্বজনপোষণ আশ্রিত পুরস্কারের স্বাক্ষর। দলদাস হয়ে সরকারি সাহায্যের ভিক্ষাপাত্রে তিনি কবিতার সম্ভ্রমকে বেচেননি।


শম্ভু রক্ষিতের নিজের হাতের লেখা কবিতা
চিত্র ঋণ : ফিনিক্স পত্রিকা, ক্রোড়পত্র শম্ভু রক্ষিত, বইমেলা ২০১০

তিনি আমাদের ঋণী করে গেলেন 'প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না', 'পাঠক, অক্ষরগুলি', 'আমি কেরর না অসুর' এরকম অনেক কবিতার বই লিখে। তাঁর কবিতার উত্তরাধিকার সামলানোর জন্য অগণিত কবি এবং পাঠক রেখে গেলেন। 


'অজয় দাশগুপ্ত স্মারক সম্মান' মানপত্র


'অজয় দাশগুপ্ত স্মারক সম্মান' এ সংবর্ধিত হচ্ছেন কবি শম্ভু রক্ষিত


১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মহাবোধি সোসাইটি হলে কবির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে


২০১২ সালে চতুর্দশ লিটল ম্যাগাজিন মেলায় পুরস্কৃত কবি শম্ভু রক্ষিত
চিত্র ঋণ : শংকর রায়

তাঁর মৃত্যুর আগের দিন কেন জানি না তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ছিলাম। এই বইয়ের অনবদ্য ভূমিকায় তিনি তাঁর কবিতা বিষয়ে লিখেছেন, 'কবিতাগুলির কোন চরিত্র ও বয়স নেই' সত্যি সময় তাঁকে, তাঁর কবিতাকে বাঁধতে পারেনি।


সস্ত্রীক কবি শম্ভু রক্ষিত
চিত্র ঋণ : গৌতম মণ্ডল


কবি শম্ভু রক্ষিত (১৬ আগস্ট ১৯৪৮ - ২৯ মে ২০২০)

রাজার মতো তাঁর মহাপৃথিবী থেকে মহাপৃথিবীর অন্য অংশে তিনি পাড়ি দিলেন। তাঁর যাত্রাপথ সুগম হোক। বাংলা কবিতার মহাকালে কবি শম্ভু রক্ষিত থাকবেন স্বমহিমায় ভালোবাসায় শ্রদ্ধায়। 

২৯ মে ২০২০, সন্ধে 

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

2 comments:

  1. খুব মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন । এখন তাঁর কাব্যের উত্তরসূরির খোঁজ বিষয়ে বলি যে, এতটাই মৌলিক তিনি যে যেকোনো দিক থেকেই তাঁর উত্তরসূরি বা অনুগামী পাওয়া দুষ্কর। তবে তাঁর পাঠকসংখ্যা অবশ্যই ঈর্ষণীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আলো ছাড়াই। এরকম সৎ সত্যসন্ধ কবি কালে অল্পই জন্মান।

    ReplyDelete

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল