সাক্ষাৎকার : কথাসাহিত্যিক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় • কথোপকথনে সোহম চক্রবর্তী


প্রাক্ সম্ভাষণ

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশক একজন কথাকার তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিটি লেখাতেই কথা বলে একেবারে স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী এক স্বর – প্রতিটি লেখাতেই তাঁর অনন্য স্বাক্ষর জ্বলজ্বল করে। আজ পর্যন্ত লেখা অগণিত আখ্যানে তিনি বহমান জীবনকে ধরতে চেয়েছেন অসংখ্য আঙ্গিকে; সমাজকে দেখতে চেয়েছেন বিবিধ অবস্থান থেকে – নানান দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় ক’রে। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক; যিনি তাঁর লেখালিখির কারণ হিসেবে একবাক্যে উদ্ধৃত করেন সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদারের অমোঘ সেই কথাগুলি – “আমি লিখি জীবনের জন্য। আমি জীবনে স্যাটিসফায়েড নই। আমি যে জীবন দেখি, তাতে যেন কোথায় তৃপ্তি পাচ্ছি না। জীবন আমাকে জাগিয়ে রেখেছে এবং জগতে আমার ভালো লাগছে না। এই জাগরণে আমার বৃদ্ধি নেই. এই জাগরণ আমাকে খর্ব করে দিচ্ছে। আমি ঐ পার্টিকুলার ধরণের এসকেপ চাচ্ছি। মায়ের জঠরে যে এসকেপ করেছিলাম। জীবনকে ছোঁয়ার, জীবনকে আদিরূপে দেখবার, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করি। আর লিখি তাদেরই জন্য যারা ‘স্বহৃদয়-সংবাদী’, অর্থাৎ যারা আমারই মতো অনুভব করে: দূর! আমি এই পৃথিবীতে কিছুই পাচ্ছি না, আমার নিজস্ব একটা পৃথিবী দরকার, যেখানে আমি আনন্দ পেতে পারি। যে মন নিয়ে আমি লিখতে বসি, সেই মন তো আমার পাঠকের থাকতেও পারে, সে তো অন্বেষণ করছে আমাকে। সেই অন্বেষণকারীর জন্য লিখি।” তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে বটগাছ। তাঁর স্নিগ্ধ-শীতল ছায়া আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকি। পাই তাঁর আশীর্বাদী পুণ্য-পরশ মাথার উপর – পাই তাঁর অপার ভালোবাসা, উৎসাহ, পথনির্দেশ আর সস্নেহ অসীম প্রশ্রয় – অবিরত। এ-সময়ের বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম কাণ্ডারি, বিরাট মনের এহেন এই মানুষটি আমার কাছে একান্ত আত্মজন, দাদা। এ আমার পরম প্রাপ্তি এক। তমাল-দা’র সঙ্গে তাঁর বাড়িতে, ফোনে, ফেসবুকে, হোয়াটস্অ্যাপে অজস্র বিষয় ঘিরে অবিরাম চলতে থাকে যে-সমস্ত অপূর্ব আলোচনা – যা আমায় পূর্ণ করে, ঋদ্ধ করে প্রত্যেকটি দিন – তারই একটি টুকরো লিপিবদ্ধ হ’ল এই সাক্ষাৎকারে। সে-অর্থে এটি কোনও ফর্মাল প্রশ্ন-উত্তরের যুগলবন্দি নয়, তমাল-দা’র সঙ্গে আমার প্রাত্যহিক জ’মে ওঠা বহু বহু গল্পের ছোট্ট একটা অংশমাত্র।

সোহম চক্রবর্তী 



দাদা, প্রথমেই একটা খুব মৌলিক প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। কেন লেখো?

হ্যাঁ, ভাই। এটা সত্যিই খুব fundamental একটা জিজ্ঞাসা। দ্যাখো, আমার লেখার কারণ হচ্ছে আমার অস্তিত্বকে অনুভব করতে চাওয়া। Rene Descartes যে-কথাটা বলছেন, “Cogito, ergo sum” অর্থাৎ “I think, therefore I am” – লেখালিখির মূল কারণ বোধহয় এইটাই। এই যে আমার বেঁচে থাকা, তার মধ্যেই যেন কোন্ একটা অচেনা সত্তার হাতছানি – লিখনপ্রক্রিয়াই তাকে অনুভব করার অনিবার্য পথ। নিজের অস্তিত্বের যে অপার রহস্যময়তা, যে বৈচিত্র্য, এই জীবনের যা-কিছু unexplored – সেগুলোকেই একটু একটু ক’রে শব্দ দিয়ে ধরতে থাকি আমি। কিছুটা ধরা যায়, অনেকটাই ধরা যায় না। কিন্তু সেই না পারাটাও আমার self বা reality-কে বোঝার অংশ হ’য়ে থাকে। এটাই আসল। প্রাপ্তি এটাই। ইংরেজ কবি Cecil Day Lewis কবিতা সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলেন, সেটিরই মৃদু পরিবর্তন যদি বলি: “We write in order to understand, not to be understood” – তাহলে এইটিই হ’য়ে উঠবে সাহিত্য তথা ললিতকলার সমস্ত শাখার মূল উদ্দেশ্যটির সর্বোত্তম generalization। আমি লিখি, কারণ আমি আসলে নিজেকেই অনুভব করতে চাই; নিজের অস্তিত্বকে, নিজের পারিপার্শ্বিক বাস্তবকে interpret ক’রতে চাই নিজের মতো ক’রে। আমার নিজের একটা দেখা আছে। আমার নিজের কিছু বলতে চাওয়া আছে। সেটাই আমার জীবনকে একটা অন্যতর অর্থ দান করে। আমেরিকান কবি Maya Angelou-র একটি বিখ্যাত উক্তি আছে: “There is no greater agony than bearing an untold story inside you” – এটিই বোধহয় সমস্ত লিখনপ্রয়াসী মানুষের সৃষ্টিশীলতার মূল কারণ। ভিতর ভিতর ঘুমিয়ে থাকা কথাটির যে অব্যক্ত ভার, তাকেই যেন রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘চিরজীবনেরই বাণীর বেদনা’। সমস্যা হ’ল, এই বাণীটির তো প্রকাশ প্রয়োজন। নোবেলজয়ী আমেরিকান সাহিত্যিক Toni Morrison বলবেন: “If there’s a book that you want to read, but it hasn’t been written yet, then you must write it”। ঠিকই। মূলগত এই তাগিদেই তো সব মানুষের লিখতে আসা। আর একটা ব্যাপার খেয়াল করো, এই লিখনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিন্তু নিজের মধ্যে সমান্তরাল একটা জগতের জন্ম দিচ্ছি আমি – সে জগতে আমিই স্রষ্টা, আমিই নিয়ন্ত্রক। এই জায়গায় এসে নিজেকে যেন ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী বোধ হচ্ছে আমার। এই আনন্দটাই লেখালিখির প্রধান কারণ। উপনিষদের কথা তুমি জানো। ব্রহ্ম যে নিজেকে ভেঙে বিশ্বসংসার তৈরি করলেন, তার কারণ কী? আনন্দলাভ। বলা যায়, অহৈতুকী আনন্দলাভ। রসের আস্বাদন। এই রস হচ্ছে একটা aesthetic emotion। রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা যদি ধরো, “ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী একা একা করি খেলা” – লিখনক্রিয়ায় আসলে এই একা একা খেলা করার অকারণ আনন্দটা পাওয়া যায়। এই অনুভূতিটা আর কোনোকিছুতেই মেলে না।


এই যে নিজের একটা দেখার কথা বললে, তোমার যেকোনো লেখার কেন্দ্রে কি সেইটাই থাকে?

একেবারেই তাই। এই দেখা, এই বলতে চাওয়াটাই আমার কাছে প্রধান। কখনও কোনও অনন্য কাহিনীর মোহ কিংবা উচ্চকিত আখ্যানের প্ররোচনা কোনোভাবে প্রভাবিত করেনি আমায়; বরঞ্চ খুব ছোট ছোট, নম্র উপাদানের মধ্যে নিহিত থাকে যে অপরিসীম সৃজন-সম্ভাবনা, তাকেই আমি যথাসাধ্য নিংড়ে নিতে চেয়েছি মাত্র। গল্প বলার দায় থেকেই যে কেবল গল্প লিখতে হবে, এ কথায় আমি বিশ্বাস ছিল না কোনোদিন। একটা কোনও ভরকেন্দ্র, একটা কোনও দর্শন, একটা কোনও impression, একটা কোনও discourse বা সন্দর্ভ – সেইটিকে বোঝা কিংবা প্রমাণ করার জন্যই গল্পের আশ্রয় নিয়েছি আমি। আমার চরিত্ররা হয়ে উঠেছে একটা কোনও বিমূর্ততার বাহন। আমার গল্প বলার ধাঁচটা ঠিক যেন কবিতার মতোই – যেখানে গন্তব্যের চেয়ে বড়ো হ’ল গমনের experience, শেষটার চেয়ে সেই শেষে পৌঁছনোর পথটা অনেক বেশি important। সে পথের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন লতাপাতা, আগাছা আর আকর্ষেরা জড়িয়ে নেয় পা; অজানা সব পথের দিকে টানতে টানতে নিয়ে যায় আপন খেয়ালে। মনে হয়, আমার কোনও গল্পই যেন ঠিক আমি লিখিনি, বরং গল্পগুলোই যেন অনর্গল লিখে গিয়েছে আমায়। কাজেই, গল্পের শুরুটা নিয়ে ভেসে যাওয়াটুকু আমার হাতে কেবল, তারপর সে নিজেই নিজের পথ খুঁজে নেবে।


এ-প্রসঙ্গে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে। গল্পের কাহিনী, নাকি তার নির্মাণ – কোনটাকে তুমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব’লে মনে করো?

অবশ্যই নির্মাণ। ভালো কাহিনী বা content-এর অধিকার সকলের। সেটাকে কে কীরকম রূপ দিতে পারছে, সেটাই আসল। একতাল মাটি সকলেই পেয়ে যেতে পারে। সেটা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত একটা মূর্তি বানাতে পারে ক’জন? আমার মনে হয়, শিল্পে form-টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।


এই ফর্ম বা নির্মাণের ব্যাপারটায় তুমি কি সচেতন থাকো?

ভীষণভাবেই। অনেকসময় হয়েছে, অনিবার্য কারণে কোনও একটা গল্পকে এমন একটা জায়গায় এনে শেষ ক’রে দিতে হ’ল আমায় – যে পরে সেটা নিয়ে চূড়ান্ত একটা অতৃপ্তি র’য়ে গেল ভিতর ভিতর; বারবারই মনে হ’তে থাকল যেন তার আরও কিছুটা চলা বাকি ছিল। কিংবা কোনও গল্প হয়তো কোথাও তেমন পৌঁছলই না – বহুবার হয়েছে, এমন কত লেখা ছিঁড়েছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি আমি। আসলে এই ব্যাপারটায় আমি বেশ খানিকটা খুঁতখুঁতে, selective। আমি চিরকাল চেয়েছি সহজ-সরল অথচ প্রসাধিত কথায় অতল গভীরতাকে স্পর্শ ক’রতে। শব্দস্থাপনা জিনিসটা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার প্রসঙ্গে কোলরিজ বলেছিলেন: “best words in best order” – আমার মতে গদ্যের ক্ষেত্রেও তাই। শব্দের ভিতরে লুকিয়ে থাকে যে সৌন্দর্য, যে সুর, যে সঙ্গীত – সেই lyricism-কে পরিপূর্ণভাবে বের ক’রে আনাটাই আমার লক্ষ্য। বাক্যের অন্বয় বা syntax-এর ব্যাপারে আমি তাই সজাগ থাকি সবসময়। বাক্যস্রোত আমার কাছে অনর্গল আসে না; আমার ভাষা সচেতনভাবে, অনেকখানি সময় ধ’রে আস্তে আস্তে নির্মিত হয়। অনেক বড়ো কোনও একটা লেখার মধ্যেও কেবল একটা বাক্য, এমনকি একটা শব্দও হয়তো আমাকে আটকে রাখে দীর্ঘকাল – ‘How will it sound?’ – এই ভাবনা ক্রমাগত খচখচ করে। এইখানটায় আমি একটু মনে ক’রিয়ে দিতে চাই, আমার ‘পাতালজল’ উপন্যাসের শিল্পীটি ছবি আঁকার পর সেটিকে টুকরো টুকরো ক’রে ছিঁড়ে ফেলেন। সেই চরিত্রটির মধ্যে হয়তো অজান্তেই আমার নিজের এই অস্থিরতাটা আরোপিত হ’য়ে গেছে।


এই যে বললে তোমার লেখা চরিত্রের মধ্যে তোমার নিজেরই ছায়া পড়েছে, এটা কি সবসময়ই হয়? মানে তোমার সমস্ত লেখায় আসলে কি তুমিই উপস্থিত থাকছ?

কিছুক্ষেত্রে হ্যাঁ, আবার কিছুক্ষেত্রে না। আমি নিজে সারাজীবন বিশ্বাস ক’রে এসেছি যে লেখকের অস্তিত্ব আসলে এক অশরীরী আত্মার মতো – যা চরিত্র থেকে চরিত্রান্তরে তার দেহ খুঁজে নেয়। উল্টোদিকে অবশ্য এটাও ঠিক যে একটি গল্পের personae-কে দেখতে হবে সবসময়ই লেখকের ব্যক্তিসত্তার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ক’রে। কোনও লেখা পড়ার সময় এটা ভাবলে চলবে না যে সেটি রচনার সময় লেখকের ব্যক্তিজীবনের প্রেক্ষাপট ঠিক কী ছিল। ‘যে আমি বাঁচি’ আর ‘যে আমি লিখি’ – এ-দু’জন যে পুরোপুরি দু’টি আলাদা সত্তা, অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে সেটা। তবু মনে হয়, লিখনক্রিয়ায় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না সবসময়। কোথাও একটা ঘুরেফিরে নিজের ছায়া পড়েই যায়। আমার ‘আমি’-টির মতোই কোনও কোনও লেখাও হয়তো সময়ের সাথে তার রূপ বদলায়। কোনও টুকরো ঘটনা, সামান্য ছবি হয়তো সময়ের সাথে হয়ে ওঠে সৃষ্টিসম্ভব – আবার কোনও কোনও বীজ হয়তো বা বন্ধ্যাই প’ড়ে থাকে। লেখালিখির পুরো জগৎ-টাই এইরকম সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম অসংখ্য সব রহস্যজালে ঘেরা; লিখতে আসার সময় এসবকিছুর ধারণাই ছিল না!


আচ্ছা দাদা, লিখনপ্রক্রিয়ার মধ্যে এই যে অদ্বিতীয় আনন্দটার কথা বললে, তার পাশাপাশি একটা অপ্রাপ্তির বোধও তো কাজ করে?

নিশ্চিতভাবেই। কথা হ’চ্ছে, ভিতরের ওই যে কথাটা আমি বলতে চাইছি, তাকে আমি ধরব কীভাবে? কোন্ কাঠামোয় নির্মিত হবে তার সার্থকতম রূপ? যে-কেউ আজ পর্যন্ত লিখতে এসেছে, পাকেচক্রে এই আবর্তটাতেই পা পড়েছে তার। লিখন একটা আত্মগ্রাসী খননক্রিয়া – কায়াহীন, বিমূর্ত অনুভূতিকে শব্দ দিয়ে ধ’রতে যাওয়ার সমূহ সর্বনাশ। সর্বনাশ, কারণ – যাকে ছুঁতে চাইছি, তাকে পূর্ণরূপে তো ছুঁতে পারছি না কিছুতেই। যেটুকু ছুঁলাম, সে তো সমগ্র অনুভবের সামান্য একটা ভগ্নাংশ মাত্র! আর ঠিক এখান থেকেই জন্ম নিচ্ছে লেখকজীবনের অনিবার্য অতৃপ্তিটা – সারাটি জীবন একে একা একা ব’য়ে চলা ছাড়া নিস্তার নেই আর। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে নোবেলপ্রাপক জার্মান সাহিত্যিক Thomas Mann-এর এই কথাটা: “A writer is someone for whom writing is more difficult than it is for other people” – তার কারণ একজন প্রকৃত লেখকের মধ্যে সবসময় কাজ করে perfection-এর এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আর তাকে স্পর্শ ক’রতে না পারার সেই অপারগ অতৃপ্তি; রবীন্দ্রনাথ যেমন বলছেন: “কী যে গান গাহিতে চাই/ বাণী মোর খুঁজে না পাই”। মজার কথাটা হ’ল, এই dissatisfaction-টাই কিন্তু একজন লেখককে তাঁর পরের লেখাটার কাছে এনে দিচ্ছে। আমি অবশ্য নিজেকে লেখক ব’লতে যথেষ্টই দ্বিধাগ্রস্ত, বরং ব’লতে পারি লিখনক্রিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, বা বলা ভালো সৃষ্ট একজন অক্ষরকর্মী। আসলে শিল্প-সাহিত্যের এই যে জগৎ, তা যেন একটা মাকড়সা, নির্মম একটা মাকড়সা – সে তার লালা দিয়ে অদৃশ্য একটা জাল বিস্তার ক’রে চুপিচুপি কোথাও লুকিয়ে আছে যেন। সেই জালে যারা পা দেয়, অসহায়, দুর্বল পোকার মতো মাকড়সাটা আস্তে আস্তে টেনে নেয় তাদের; অলৌকিক এক বিষ যেন ঢুকিয়ে দেয় তাদের শরীরে – সেই বিষে বুঁদ হ’য়ে থাকে তারা সমস্ত জীবন। এই আচ্ছন্নতা কিন্তু কেবল কোনও কাব্যকথা নয়, লিখনপ্রক্রিয়ায় আপন অস্তিত্বের যে অনুভব ঘটে, তা বোধহয় আর অন্য কিছুতেই ঘটতে পারে না – যে-কথা শুরুতেই বলছিলাম আর কী।


দাদা, একটা জিজ্ঞাসা। অনেকক্ষেত্রেই আমরা দেখি কথাসাহিত্যিকেরা তত্ত্বের ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন থাকেন না। প্রচলিত, প্রথাগত অ্যাকাডেমিকস্-এর বিরুদ্ধ স্বর তোমার ‘মায়াকাচ’-এও আমরা পেয়েছি। কিন্তু তুমি নিজে তাত্ত্বিক জায়গাটায় যথেষ্ট সচেতন। তোমার প্রবন্ধ-সংকলন ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’-তেই আমরা, পাঠকরা তার অনেকখানি পরিচয় পাই। এই বিষয়টা নিয়ে একটু যদি বলো...

ঠিকই। লেখার ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশ সচেতনই থাকি। ধরো, জীবনানন্দের ‘বিড়াল’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঘ’ ইত্যাদি নিয়ে আমার তন্নিষ্ঠ পাঠ আছে। তুমি যে বইটার কথা বললে, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’, সেটাতে এইসমস্ত বিষয়ে আমার কিছু প্রবন্ধ সংকলিত আছে। তোমার সাথে রবীন্দ্রনাথের গান থেকে দেরিদার deconstruction – এরকম কত বিষয়ে কত কত আলোচনা হয়েছে, বলো! এই deconstruction-এর জায়গাটাই যদি ধরো... এই যে ‘মায়াকাচ’-এর প্রসঙ্গ আনলে, সেই সূত্রে ব’লি... লক্ষ্য করবে, ‘binary’ ব্যাপারটাকে কিন্তু ‘মায়াকাচ’-এ খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই যে সাদা-কালো, ভালো-খারাপ, সুন্দর-অসুন্দর – এইরকম অজস্র binary আমাদের ব্যবহারে অহরহ চ’লে আসে, আমি তাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি, প্রথাগত use-টাকে সম্পূর্ণ উল্টো ক’রে দেখাতে চেয়েছি, পুরোপুরি বিপরীত অভিমুখে। এটাই deconstruction-এর মূল কথা। এই যে ‘মায়াকাচ’-এর ছেলেটির মধ্যে প্রচলিত academics-এর একটা বিরুদ্ধ স্বর শোনা যাচ্ছে কিংবা সে প্রেমে পড়ছে বাহ্যিক নিরিখে তথাকথিত অসুন্দর একটি মেয়ের – এগুলো কোনোটাই কিন্তু আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে না। এগুলো সে-অর্থে প্রথাগত ধারার বিপ্রতীপ। তারপর ধরো আমার ‘ব্রাহ্মণী’ উপন্যাসে পুরুষকেন্দ্রিকতা বা Phallocentrism-এর সম্পূর্ণ বিপরীত একটা voice আছে। আবার তুমি দেখবে, সারা পৃথিবীতে অগুনতি উপন্যাস লেখা হয়েছে সুন্দরী কোনও নারীকে কেন্দ্র ক’রে। কিন্তু তার একেবারে উল্টোপথে হেঁটে আমার ‘কন্দর্প’ উপন্যাসটায় আমি ধরতে চেয়েছি একজন কন্দর্পকান্তি পুরুষের একাকীত্ব, তার crisis। আবার দ্যাখো, এই উপন্যাসের মেয়েটি ওইরকম সুদর্শন একজন পুরুষের প্রতি স্বভাবজ আকর্ষণের চেয়ে অনেক বেশি সন্দেহ পোষণ করছে মনে মনে। এইরকম বিভিন্ন বৈপরীত্য আর ব্যতিক্রম আমি খুব সচেতনভাবেই নির্মাণ করতে চাই আমার লেখায়।


তোমার ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু বলো। লেখালিখির শুরু কিংবা শুরুর ভাবনা কি ছোট থেকেই?

না, ভাই। লিখতে যে আসব, এ-কথা শুরুতে একেবারেই ভাবিনি। তবে হ্যাঁ, শিল্পের প্রতি তুমুল একটা ঝোঁক আমার ছোট থেকেই ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি ছবি আঁকতাম। Painting নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার ভরপুর স্বপ্ন ছিল চোখে। মূলত oil painting বা জলরঙে surreal বা বিমূর্ত ছবি আঁকার দিকেই আগ্রহ ছিল বেশি। অর্থাৎ, commercial নয়, fine arts-এর প্রতিই আমার চিরকালীন প্রবণতা ছিল। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, কোনও না কোনও মাধ্যমে শিল্পীই কিন্তু হ’তে চেয়েছি আমি ছোট থেকে। তবে লেখায় আসার ইচ্ছা জন্মায় অনেক পরে। আমার পরিবারের সাংস্কৃতিক background-টা ছিল খুব মজবুত। মামার বাড়িতে ছিল vibrant একটা সাংগীতিক পরিমণ্ডল। দাদু নন্দগোপাল (মণ্টু) আচার্য নিয়মিত বেতারশিল্পী ছিলেন – মূলত দেশাত্মবোধক গান গাইতেন, এইচএমভি থেকে তাঁর একাধিক অ্যালবামও ছিল। ছোটবেলায় ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার পাতায় তাঁর ছবি দেখেছি আমি। মা ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছাত্রী – ফিফথ কি সিক্সথ ইয়ারের পরীক্ষা দিচ্ছেন তখন। মনে আছে, আমায় ঘুম পাড়ানোর সময় মা আর ছোটপিসি গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান – একটার পর একটা। কোন্ সেই ছোটবেলায় ঘুমপাড়ানিয়া গান হ’য়ে আমার ভিতর সংক্রামিত হ’য়ে যায় “আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা”, “অশ্রুনদীর সুদূর পারে”, “চিরসখা হে”, “তুমি একেলা ঘরে ব’সে ব’সে কী সুর বাজালে” কিংবা “ওগো দুখজাগানিয়া তোমায় গান শোনাবো” – এইরকম একেকখানা উচ্চারণ! হু হু ক’রে ঢুকে আসে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত কিংবা নজরুলের গান। প্রথম প্রথম ভয়ানক দুর্বোধ্য ঠেকলেও ধীরে ধীরে আত্মার মধ্যে জড়িয়ে যায় সেইসব কথা আর সুর। বলা যায়, সেই আমার নন্দনচর্চার প্রথম প্রেরণা। সেই সমস্ত ঘুমপাড়ানিয়া গানই আস্তে আস্তে হ’য়ে ওঠে আমার ঘুমভাঙানিয়া। মনে হ’তে থাকে, চিত্রকলার নিজস্ব ভাষা ও স্বকীয়তা অর্জন ক’রে তারপর তা দিয়ে আমার নিজস্ব দেখাটাকে ধরার চেয়ে শব্দ দিয়ে, বাক্য দিয়ে, অক্ষর দিয়ে সেই কাজ বোধহয় আরও সহজে ক’রতে পারব আমি। রেখার চেয়ে লেখাই হয়তো হ’য়ে উঠতে পারে আমার আত্মপ্রকাশের সহজতর মাধ্যম। ওদিকে আমার বাবার বংশধারাটিতে আবার সনাতনী ব্রাহ্মণ্য আচার-আচরণ, পূজার্চনার নিয়মনিষ্ঠ চর্চা ও চল ছিল। সেই প্রভাবে ততদিনে পুরাণ বা বৈদিক গ্রন্থ ইত্যাদি পাঠের প্রতি কিছুটা উৎসাহ তৈরি হয়েছে আমার। বাড়িতে চলছে রেডিও, পত্রপত্রিকা আসছে। আমার মামা, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী ও বাকসিদ্ধ কবি স্বপনবরণ আচার্যের নিয়ত সংস্পর্শ পাচ্ছি আমি। ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোচ্ছে সেইসময়, ‘জলসত্র’ বা ‘আত্মহত্যাকলা’-র মতো কবিতা রীতিমতো সাড়া ফেলছে পাঠকমহলে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখছেন ‘কবিতা তো এখন মফস্বলের’। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে আঁকা থেকে ধীরে ধীরে লেখার দিকে সরে আসতে থাকি আমি। প্রথম জীবনে কবিতা লিখতাম। মামা স্বপনবরণ প্রচণ্ড বকাঝকা করতেন, আবার বাহবা দিতেন, পথ দেখাতেন। সেসব থেকেই আস্তে আস্তে লেখায় উৎসাহ বাড়ে। সাথে সাথেই বাড়তে থাকে ‘কিচ্ছু হচ্ছে না’ – ওই একটা অতৃপ্তিবোধ। ‘কিচ্ছু হচ্ছে না’ – তাহলে কীভাবে হবে? কীভাবে হয়? এই যে ‘How?’ – প্রকাশের এই ভঙ্গিটাই শিল্প। এই জিজ্ঞাসাটাই শিল্পীর অপ্রাপ্তি, যেটা বলছিলাম।


এই যে মফস্বলের কথাটা এল, এ-প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করি – এই শহর, কৃষ্ণনগর, তোমায় কতটা প্রভাবিত করেছে?

দ্যাখো, Browning বলেছিলেন যে শহরের আত্মা নাকি লেখকের উপর ভর করে। আমার ক্ষেত্রে অন্তত কথাখানা একশোভাগ সত্য। কৃষ্ণনগর – যে জনপদ আঠেরো শতকে বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী; কৃষ্ণচন্দ্রের মতো রাজা তাঁর রাজত্বকালে যেখানে দেখছেন এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর স্বপ্ন – ভারতচন্দ্র যেখানে বসে নির্মাণ করছেন আধুনিক বাংলা ভাষার structure, রামপ্রসাদ গাইছেন গান; যে শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে রামতনু লাহিড়ী, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতগুরু বিষ্ণু চক্রবর্তী, পরবর্তীতে দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নজরুল ইসলাম কিংবা অমিয়নাথ সান্যাল প্রমুখ উজ্জ্বল সব নাম; আমার ছোটবেলা থেকেই যে শহরে দেখছি সুধীর চক্রবর্তীর মতো প্রাজ্ঞ গবেষক-অধ্যাপক, দেবদাস আচার্য কিংবা স্বপনবরণ আচার্যের মতো শক্তিশালী কবি এবং আরও অনেক অনেক কৃতবিদ্য মানুষকে – সেই শহর কখন, কোন্ অজান্তেই যেন তার এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের বীজটা পুঁতে দিয়েছে আমার ভিতর। একটা পুরোনো শহরের স্বভাবগত মেজাজ, বলা যায় একপ্রকার কৌলীন্য এবং একটা ‘high brow’ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই জন্ম হয়েছে আমার। উৎকর্ষের নিরিখে প্রতিনিয়ত নিজেকে নিজে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াই তাই সে-দিক থেকেও ছিল। এই struggle-টা আমার ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক হয়েছে।


তোমার স্কুল-কলেজ জীবনের কথা একটু শুনি। সেই সময়টায় তোমার লেখালিখির কথা একটু বলো।

স্কুলজীবন থেকেই আমাদের কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি আর মেধা-মননের একটা যেন সুপ্ত প্রতিযোগিতা ছিল। মাধ্যমিক পাশের পর আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একটা সংঘ গড়ে ওঠে। সেসময় গানের দলের মতোই লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকে ঘিরেও সকলের একটা বিরাট উন্মাদনা ছিল। তখনই আবার ‘মুদ্রা’ পত্রিকার জন্ম। তখন সিলেবাসে পাওয়ার আগেই আমি পড়ে ফেলছি এলিয়ট কিংবা এজরা পাউণ্ড, নিজের মতো ক’রে অনুবাদ করছি বোদলেয়রের কবিতা। মুদ্রা পত্রিকার সুবাদে অনুবাদের একটা অভ্যাস তৈরি হয় আমার। কলেজস্ট্রীট বই-বাজারের বিপুল exposure তো নেই তখন – তাই, নিজের মতো করেই dictionary ঘেঁটে অনুবাদ করতে থাকছি ও হেনরি, ক্যাথেরীন ম্যান্সফিল্ড, জেমস জয়েস, আন্তন চেখভ, মায়াকোভস্কি, রিলকে প্রভৃতি বহু বহু লেখক-কবির লেখা। কী ভীষণ আনন্দের একটা দরজা খুলে যাচ্ছে যেন।

এরপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে আসি কলেজে। এমন সময় ‘অভিযোজন’ নামে একটি গল্প লিখে অনেকের কাছে প্রশংসিত হলাম। এই গল্পটা আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় – কারণ, এখান থেকেই আমার লেখকজীবন সে-অর্থে নতুন বাঁক নেয়। এটি একটি রোগা, নির্জন, অন্তর্মুখী ছেলের গল্প – যার বাবা বদ্ধ উন্মাদ, আর তাই তার মা বলতে গেলে প্রায় বৈধব্যই পালন করেন। বাড়িটির একেবারে কোণের একটি ঘরে তার বাবা থাকেন, সেখানে কেউ যায় না, মাঝে মাঝে শুধু সেই ঘর থেকে ভেসে আসে বাখ, শুবার্ট, হ্যান্ডল বা মোৎসার্টের সব সিম্ফনি। সে ঘরের পর্দার ফাঁক গলে উপুড় হ’য়ে পড়ে থাকা বাল্বের আলো মাঝে মাঝে ছুঁয়ে থাকে ছেলেটি – ওটুকুই তার কাছে বাবার স্পর্শের মতোন। পরবর্তীতে সুধীর চক্রবর্তী গল্পটি নিয়ে গিয়ে পোঁছে দেন অমৃতলোক পত্রিকার দপ্তরে। পত্রিকার তরফ থেকে সমীরণ মজুমদার আমায় ফোন ক’রে সেটি প্রকাশের কথা জানান। অমৃতলোকের ‘বিশেষ কথাসাহিত্য’ সংখ্যার প্রথম গল্প হিসেবেই ছাপা হয় সেটি – তার পরে ছিল বিপুল দাস প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত সব লেখকদের গল্প। নির্মাণের একেবারে প্রাথমিক সেই বয়সে বিরাট এই প্রাপ্তি আমায় অনেকখানি উদ্বুদ্ধ করে। তারপর আমার আরেকটি গল্প সুধীরবাবু দিয়ে এলেন ‘অক্ষর’ পত্রিকায়। আমার জীবনের এই সময়টায় সুধীরবাবুর ভূমিকা অপরিসীম। ওঁরই উৎসাহে ওঁর বইয়ের ইংরাজি অনুবাদের কাজে হাত দিই আমি; ‘বুদ্ধিজীবীর নোটবই’ নামক ওঁর বিখ্যাত সংকলনটিতে ‘ট্র্যাজেডি’ ও ‘কমেডি’ – এইদু’টি বিষয়ে দু’খানি প্রবন্ধ লেখার অসামান্য একটা সুযোগও পেয়ে যাই।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীনই আমার নাটক করার সূত্রপাত। সেই সুবাদে ম্যাকবেথ চরিত্রে অভিনয় করার সৌভাগ্যও ঘটেছে বলতে হয়। সেসময় আমি অনুবাদ ক’রি স্যামুয়েল বেকেটের ‘Waiting for Godo’ নাটকটির অনেকখানি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনীত ‘Rising of the moon’ নাটকটির অনুবাদের দায়িত্বও পড়ে আমারই উপর। তাছাড়া নিজের লেখা কিছু কিছু গল্প প্রকাশ পেতে থাকে তখন তারই সাথে।


আচ্ছা। তারপর?

তারপর, এই সময়টার বেশ কিছুটা পরে, মোটামুটি ২০০৭-০৮ সাল নাগাদ আচমকাই একদিন আমার কাছে ফোন আসে নবারুণ ভট্টাচার্যের। আমার কাছে গল্প চেয়েছেন উনি, দেখাও ক’রতে চেয়েছেন! প্রথম ধাক্কায় এ চমক অবিশ্বাস্য মনে হলেও শেষমেশ একদিন দেখা হয় ওঁর সাথে। সেসময় তাঁর সঙ্গে অনুবাদের বহু বহু কাজ করেছি আমি। ‘আলোর মিছিল’ segment-এ অনুবাদ করলাম স্যামুয়েল বেকেটের জীবনী। তারপর চলল একের পর এক অনুবাদের পালা – কাইফি আজমির কবিতা, কমলা দাসের কবিতা, নিসিমি ইজিকিয়েলের কবিতা, শশী কে কুমারের গল্প। নিজস্ব গল্প লেখাও চলতে থাকে সমান তালে। ২০০৯ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘বাবা’ গল্পটি। আবার এ-ঘটনার ঠিক তিনদিনের এদিক-ওদিকে ব্যক্তিগত জীবনেও বাবা হলাম আমি! যাই হোক, এইখানটায় ঘটল আমার জীবনের বিশাল বাঁকবদল। পথিক গুহ জানালেন, ‘বাবা’ গল্পটি ভালো লেগেছে সাক্ষাৎ রমাপদ চৌধুরীর! দেবেশ রায়ের মতো মানুষ প্রাণভরা উৎসাহ দিলেন আমায়! সেই সময়টাতেই আমার মনে হ’ল, এইবার একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবা যেতে পারে। এখান থেকেই ‘মায়াকাচ’ তার সুতো পাকানো আরম্ভ ক’রল ভিতর ভিতর।


সেই ২০১১-র ‘মায়াকাচ’ থেকে আজ এই আট-ন’বছরে ছোটগল্প, উপন্যাস, সম্পাদিত বই – সব মিলিয়ে মোট কুড়িটি বই আমাদের উপহার দিয়ে দিয়েছ তুমি। যদি উপন্যাসের কথাতেই আসি, ব্যক্তিগতভাবে তোমার লেখা কোন্ উপন্যাসটি তোমার নিজের সবচেয়ে প্রিয়?

ওভাবে একটা উপন্যাসকে তো সবচেয়ে প্রিয় ব’লে বেছে নেওয়া যায় না, ভাই; তবে আমার মনে হয় এখনও পর্যন্ত ‘ঘাতক’ আমার সবচেয়ে সুলিখিত উপন্যাস। পুরো লেখাটার narrative third person-এ নয়, first person-এ। এই উপন্যাসটাই সবচেয়ে নিপুণ, well-written।


সুযোগ পেলে নিজেরই কোনো একটা উপন্যাসকে আবার লিখতে ইচ্ছে করে?

হ্যাঁ। সময়ের টানাপড়েনের জন্যে ‘মর্মমেঘ’ উপন্যাসটা আমি মনের মতো ক’রে শেষ করতে পারিনি। যে সম্ভাবনা নিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল, বারবারই মনে হয় শেষে পৌঁছে তার প্রতি proper justice করা হ’ল না। এই উপন্যাসটা সুযোগ পেলে আবার লিখতে পারতাম।


সমকালীন বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে তোমার কী মতামত?

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া খুব ইতিবাচক। এই সময় একসাথে এত ধরণের লেখা হচ্ছে, যেটা বাংলা ভাষায় আগে কখনও হয়নি। হয়তো তাদের মধ্যে ভূত-প্রেত, তন্ত্র, রহস্য-রোমাঞ্চ এসবও রয়েছে, কিন্তু এই সময় বাংলা সাহিত্যে বহুরকমের গবেষণা, বহুধরণের ভাবনার একটা confluence ঘটছে, যার ফলে তা নিঃসন্দেহে বিকশিত হচ্ছে। কিন্তু মহৎ লেখা হচ্ছে কী না, সেটা কাল বিচার করবে। অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে, এই যে ‘মহত্ত্ব’, তার নিরিখগুলিকে ৫০-৬০ বা ৭০-এর দশকের প্রেক্ষিতে বিচার করাটা ভুল হবে। আমার মনে হয়, এই সময় দাঁড়িয়ে কালজয়ী সাহিত্যরচনার মূল অন্তরায় হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের শিবির বিভাজন। একটা ধারা, যেটা সে-অর্থে ‘mainstream’, সবসময় তার বিরুদ্ধে রয়েছে আরেকটা ধারা। তাদের বৈরিতার কারণও আছে যথেষ্ট। আরেকটা প্রবণতাকে আমার ভীষণ ক্ষতিকর মনে হয়। সেটা হ’ল সমকালকে generalize করা। কিছুটা সময় না গেলে একটা কালকে কিছুটা দূর থেকে দেখা সম্ভব না। বহু সাহিত্যবেত্তা, বহু সমালোচক সেটা মাথায় না রেখেই সমকালকে একরকমভাবে generalize করে ফেলছেন। বলছেন, এ-সময়ের সাহিত্য মূলত অগভীর, বাণিজ্যিক, ভাষা-সচেতন নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এই generalization-এর ফলে অন্যতর প্রয়াসগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। আবার এটাও ঠিক যে social media আসার পর মানুষ সবসময় এগুলোর প্রত্যাশীও নন। প্রচুর নতুন লেখক উঠে আসছেন, নতুন ধরণের narrative রচনা করছেন, নতুন বাজার তৈরি করছেন। অর্থাৎ সোজা কথায় বাজারটা এখন অনেক বেশি মুক্ত। সাহিত্য আলোচনার নিরিখগুলোও সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সমালোচনার ক্ষেত্রটা এখন বিস্তীর্ণ। এটা থাক। অবশ্যই থাক। আমরা যেমন বাবার জীবনের প্রেক্ষিতে ছেলের জীবনকে দেখি না, ঠিক তেমনি ঘোর সমকালকে আগের দশকগুলোর মানদণ্ডে বিচার করার ভুলটা করব কেন? এবার অনেকে বলবে, মানদণ্ড চিরকাল একই। কিন্তু এটা সবসময় ঠিক নয়। মানছি যে ম্যাজিক মাউন্টেন, ইউলিসিস, ঘরে বাইরে কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথা এগুলি চিরকালই মহান কাজ। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সমস্যাটা হচ্ছে যে, সাহিত্যের যে ভোক্তা, তার চরিত্র বদলে গেছে। 


আচ্ছা দাদা, এই করোনা-কালের পরে কি বাংলা সাহিত্যের ভোক্তা বা পাঠকগোষ্ঠীর কোনও পরিবর্তন আসবে?

আমার ধারণা, এই করোনা অতিমারী উত্তর সময়ে বাংলা সাহিত্যের পাঠককুলের একটা বড়সড় বদল আসবে। কীরকম বদল, তা পুরোপুরি predictable নয়, কিন্তু বদল একটা আসবেই। কঠিন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা সাহিত্য যাবে এবং আমার ধারণা, থেকে যাবে। এখন যেমন ওয়েবসিরিজের যুগ। তার ফলে সিনেমা-শিল্পটা চোখের সামনে বদলে গেল। ওয়েবসিরিজের আট-দশটা এপিসোডে লাভ হচ্ছে এই যে, সিনেমায় একেকটা চরিত্র বিকাশের যে সময়গত সীমাবদ্ধতা ছিল, তা এখন আর থাকছে না। ফলে তার পরিসরটা বাড়ছে। কে জানে বাংলা সাহিত্য এরকমই অন্য কোনও একটা দিক নেবে কী না? অর্থাৎ, আমরা একটা যুগসন্ধিতে দাঁড়িয়ে আছি। সুতরাং এখনই সেরকম কোনও statement করা সম্ভব নয়। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সময়ই সবচেয়ে বড়ো নায়ক। সময়ই অনেককিছু নির্ণয় করে।


বেশ। আগের আলোচনায় ফিরে আসি। তোমার সমকাল...

এতক্ষণ সমকাল সমকাল বলছি, আমার সমকালটাকে ঠিকঠাক specify করা দরকার। আমি বলছি শূন্য দশক, অর্থাৎ ২০০১-এর পর থেকে যাঁরা লিখতে এসেছেন, লেখালিখি করছেন আজ প্রায় কুড়ি বছর, তাঁদের কথা। যেমন ধরো, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিলোত্তমা মজুমদার – আরও অনেকে। বিশেষ ক’রে বলি, তিলোত্তমা-দি এই সময়ের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকা, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আমার আক্ষেপ, তাঁর যে গভীরতা, ভাষানির্মাণে তাঁর যে দক্ষতা – তিনি যেহেতু কোনও একটা প্রতিষ্ঠানে লেখেন – তাই সেগুলির সম্পূর্ণ মূল্যায়ন হয়নি। এই সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, আমাদের সময়টা একটা misunderstood time – বিক্ষিপ্ত, স্ববিরোধী, বিভিন্ন ধারার একটা মোহনা যেন। ফলে এই সময়টাকে বুঝতে অন্তত ১০-২০ বছরের দূরত্ব লাগবে। এত সহজে, এই কালের মধ্যে থেকে এই কালটাকে বোঝা খুব কঠিন। অনেকে বলেন, এই সময়টায় নাকি বাংলা সাহিত্য পড়া হচ্ছে না। আমার তো এটা একেবারেই মনে হয় না। লিটল ম্যাগাজিনের পাঠ বাড়ছে। এই একটা স্বতন্ত্র ধারা এ-সময়ের বাংলা সাহিত্য, বিশেষ ক’রে বাংলা কবিতার জগতকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করছে; একটা শক্তিশালী প্রতিস্বর হ’য়ে উঠে আসছে। মাঝের কয়েক দশক বাংলা বই বিক্রির একটা খারাপ অবস্থা হয়েছিল ঠিকই, এখনও হয়তো সেটা রয়েছে, কিন্তু বাংলা প্রকাশনাগুলো এর জন্য মূলত দায়ী। সেভাবে প্রচার নেই, রিভিউ করার সংগঠিত ক্ষেত্র তৈরি নেই। ফেসবুক, হোয়াটস্যাপে রিভিউ ক’রে তো সেভাবে কোনও insight তৈরি হচ্ছে না। এরকম বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। আমার মতে, মূল কথা হ’ল বাংলা সাহিত্যের বাজারটাকে সংগঠিত করা ভীষণ প্রয়োজন।


আচ্ছা, দাদা। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমায়। আজ তাহলে উঠি...

হ্যাঁ, ভাই। আজ এই পর্যন্ত থাক। আবার পরে কথা হবে।


••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••


তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়


জীবনপঞ্জি

কথাসাহিত্যিক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১২ই জুলাই ১৯৭৮, নদীয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরে। পিতা স্বর্গত তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মা তপতী বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল থেকে কলাবিভাগে উচ্চমাধ্যমিক। ইংরাজি সাহিত্যে কৃষ্ণনগর সরকারী মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা। লেখা প্রকাশিত হয় দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, আনন্দমেলা, সানন্দা, সংবাদ প্রতিদিন সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সমাদৃত হয়েছে পাঠক ও সমালোচক মহলে। লেখকের গল্প অনুদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। সম্পাদিত পত্রিকা ‘মুদ্রা’। ১৪১৮ বঙ্গাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মায়াকাচ’ উপন্যাসের জন্য সংবাদ প্রতিদিন আয়োজিত পাঠকের মূল্যায়নে পেয়েছেন বর্ণপরিচয় সাহিত্য সম্মান ২০১১। অর্জন করেছেন নতুন কৃত্তিবাস পুরস্কার (সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্মাননা ২০১৬), বাংলা অকাদেমি পুরস্কার (সোমেন চন্দ সম্মাননা ২০১৭), রোকেয়া সাহিত্য সম্মান।




সম্পূর্ণ গ্রন্থপঞ্জি

১| মায়াকাচ — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১২)
২। মর্ম মেঘ — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৩)
৩| ঘাতক — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)
৪। কেল্লার গুপ্তধন — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)
৫| অসময়ের রূপকথা — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)
৬। উত্তরপুরুষ — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)
৭। ভ্রান্তিডানা — মিত্র ও ঘোষ (২০১৫)
৮। ব্রাহ্মণী — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৬)
৯। সোনালি ডানার চিল — দে’জ পাবলিশিং (২০১৬)
১০। পাতালজল — দে’জ পাবলিশিং (২০১৭)
১১। ব্রত ফিরে এলো — মন্দাক্রান্তা (২০১৭)
১২। অন্ধ আলোর চোখ — প্রতিভাস (২০১৮)
১৩। সেরা পঞ্চাশটি গল্প — দে’জ পাবলিশিং (২০১৮)
১৪। রানাদার সঙ্গে — দে’জ পাবলিশিং (২০১৯)
১৫। কম্পাসওয়ালা (দেজ) ২০১৯
১৬। কন্দর্প (আনন্দ পাবলিশার্স) ২০২০
১৭। রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য ( মন্দাক্রান্তা)
১৯। 'তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পবই', প্রকাশক--- আলপথ
২০। তর্জমায় বিশ্বসাহিত্য /সম্পাদিত গ্রন্থ (মুদ্রা) ২০২০

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

2 comments:

  1. সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়ে মুগ্ধতায় ভরে গেল মন। অনেক প্রাপ্তি। অভিনন্দন ও ধন্যবাদ লেখক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ তালে তাল মিলিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সোহম চক্রবর্তীকে।

    ReplyDelete

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল