কবিতা : রণজিৎ অধিকারী



উষ্ণতা ও কম্পন বিষয়ক কবিতা 


একটি আলিঙ্গনের আয়ু আলিঙ্গন শেষ হওয়ার আগেই ফুরিয়ে যায়। 
কজনইবা জানে অর্গাজমে যোনি কেঁপে ক্রমে স্থির হয়ে আসে! 
তারচেয়ে একটা সফল সঙ্গমও স্বল্পায়ু ; —কেউ 
এতসব না ভেবেও ভেবে নেয় জীবন এক সংকলন কিংবা 
জীবনের কিছুই না-ফেলার সংকল্প নেয় হয়তো অনেকেই ; তারা 
সকলেই বিস্তর আসবাব আর পোশাক-আশাকের বহুলতা দিয়েই 
বানাতে চেয়েছে শান্তিনিকেতন —না বুঝেই যে, 
উষ্ণতা, প্রাণের কম্পন কোথা থেকে আসবে! 

যে পাহাড়েরা অনেক আগেই লাভা বের করেছিল বলে আজ 
চুপ করে গেছে —তাদেরও কৈফিয়ত নেওয়া যেতে পারে ; কৈফিয়ত 
দিক তারাও —যারা আজ বীর্যহীন, নেতিয়ে পড়া, জরাগ্রস্ত! 
আদতে কোন কোন শিরা উপশিরার ভিতর দিয়ে বয়ে আসা উষ্ণতা 
আমাদের আজও টানটান উন্মুখ করে তোলে? তারপর 
সেই পথ ও সুড়ঙ্গগুলি বন্ধ হয়ে যায় কেন —তা না ভেবেও 
আরো বহু বহুকাল এই গ্রহে কেটে যাবে আমাদের ; হয়তো 
অতি অল্পজনেই অর্গাজমে কেঁপে টের পায় —
যোনির কম্পনে থেকে গেছে মহাজাগতিক আলোড়নেরই স্মৃতি! 




বরফ বিষয়ে সিদ্ধান্ত 


হাজার হাজার বছর আগেও কি বরফ গলেনি? 
বরফ গলে যাওয়া বরাবরই খুব ভালো ব্যাপার। 
তোমার আমার মধ্যে জমে ওঠা বরফ যেন কতবার 
অলিখিত নিয়মের মতো কোনো মঙ্গলবার বিকেলের দিকে 
গলে গেছে ; তারপর পুনরায় তা জমিয়ে তুলেছি। 

চিরকালই কল্পনাশক্তি মানুষকে অন্ধ করে রেখেছে —যা নেই, 
সে তা-ই দেখতে চায় ...কেন যা দূরে কেবল সেইদিকে চেয়ে থাকে? 
আমি বরফের টুকরো হাতে নিয়ে দেখেছি —সে কেবলি নিচের দিকে 
                                গলে পড়তে থাকে।   

যখনই বুকে ব্যথা জমাট বাঁধতে থাকে —তোমাকে বলি —
এ নতুন কিছু নয় ; আবারও গলতে শুরু করবে... 
শুধু একটা মঙ্গলবারের অপেক্ষা। হাজার হাজার বছর ধরে 
এইসব দিনগুলোকে এভাবেই পরপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। 




কোথায় স্তব্ধ হয়ে আছে? 


নিঃসঙ্গ বরফ আর সানুদেশের সরলবর্গীয়দের মধ্যে 
যে কথোপকথন —তা স্তব্ধ জমাট হয়ে আছে কোথাও। 
আমরা এখনো গ্রানিট পাথরের কাছে যেতে পারিনি, এমনকি 
পৌঁছাতে পারিনি আরো সহজ সাদাসিধে —যারা 
অল্প সংবেদনে সাড়া দিয়ে ফেলে তাদের কাছেও। 
হিসেব করো অতশত বিপুলতার ভেতরে আমরা সত্যি হয়ে 
কোথায় আছি! — কীভাবেইবা যাবতীয় অর্থ অনর্থ 
বুঝবার দাবি করতে পারি! 
মনুষ্যরচিত কবিতা বড়জোর একটা ভাঙা ডানা, এক পলকা হাওয়া বা একচিলতে শূন্যতার মতো! 
ধরো, অগম জলের নিচে 
চাপা পড়া টুকরো পাথর — কত কত যারা অনাবিষ্কৃত ;
কত কত আকাশ যারা নীরব —আমরা ভেবে তার কূল পাব? 
ভাবি —নিঃসঙ্গ বরফ আর সানুদেশের সরলবর্গীয়দের মধ্যে 
কথোপকথন কোথাও দীর্ঘ জমাট কবিতার মতো 
                                                   স্তব্ধ হয়ে আছে।




এমনকি তোমার বুকের পাথরও 


পাথরের যা আছে, তা হল কিছু বলার ইচ্ছে 
কিন্তু কখনোই মুখ খোলেনা তারা। ঠান্ডা পাথর হাতে নিলেই 
টের পাবে —লক্ষ কোটি বছরের স্মৃতি সে অটুট রেখেছে অথচ 
এই সামান্য কামিনী ফুলের গন্ধ কেমন তা তারা বলতে পারেনা। 

যেমন বস্তু, যারা সর্বদাই নিজেকে চিহ্নিত করতে পারে কিংবা 
জানে নিজের স্থান নির্দিষ্ট করে ফেলতে! পাহাড়ের গা থেকে 
খসে পড়া চাঙড় খাদের দিকে নেমে যেতে থাকে —আমি যেন 
তার বাঁকা হাসি লক্ষ করি ; কিন্তু কেন কিছু বলেনা সে? 

কীভাবে তারা জমাট ও বোবা হয়ে গেল —আমরা এসে সেসব দেখিনি। 
কিংবা তাদের ভাষা যা আমাদের বাচাল ভঙ্গিমা ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেল! 
হয়তো তারাই নিবিড়তরভাবে বুঝেছিল রৌদ্র আর ঠান্ডার মহিমা! 
সব দেখেশুনে অভিমান হতে পারে তাদেরও যে, 
আমাদের সমূহ অর্থোদ্ধারের চেষ্টা কেবল সাময়িক —চিরায়ত কিছু নয়। 

পাথরে হাত দিলে আজও টের পাই — তার বলার ইচ্ছে জমাট হয়ে আছে ;
এমনকিছু, যা আমরা কখনো বলিনি ও শুনতে চাইনি। 



বিছানা 


এত স্বল্পায়তন বিছানায় আমাদের চলবে কীকরে? 
যতদিন যাচ্ছে আরো কমে আসছে আমাদের খেলার জায়গা। 
যখন কৌপিন পরে থাকতাম —সেদিনগুলো এত ছড়ানো ছিল যে 
সুখদুঃখের গোঁগানি খোলা প্রান্তরের হাওয়ায় গিয়ে মিশত আর 
আমাদের মিলন-দৃশ্য আকাশ থেকে সবকটা নক্ষত্রই দেখতে পেত। 
আরো ঘন আরো নিবিড় হয়ে আসা উপত্যকার দিকে 
দিন গড়িয়ে এল কীভাবে! 

এখন এই স্বল্পায়তন বিছানায় আমাদের খেলা দেখার কেউ নেই ;
আজ উদগ্রীব নাক্ষত্র দৃষ্টি বস্তুর পাহাড় পেরিয়ে পেরিয়ে 
এই কোটরে এসে পৌঁছয়না। 
যতদিন যাচ্ছে আরো শীতল হয়ে আসছে আমাদের 
                                             সংকীর্ণ বিছানা। 

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

14 comments:

  1. অনবদ্য কবিতা। রণজিৎ এইমুহূর্তে আমার কাছে অন‍্যতম প্রধান কবি। প্রতিটি কবিতাই যুক্তির সংবেদনে গাঁথা। এইসব কবিতা আমাদের নিয়তি।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো কবিতাগুচ্ছ। শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ যথাযথ।

    ReplyDelete
  3. খুবই ভালো লাগল। বৈদগ্ধ অথচ মিঠে এক সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে এর প্রদেশ। সূক্ষ্ণ অনুভূতির সেই সাড়াতে দিশেহারা হতে হয়।

    ReplyDelete
  4. সঞ্জনাJune 16, 2020 at 1:31 AM

    এই কবিতার কাছে আসতেই হবে আমাদের।

    ReplyDelete
  5. বড় ভালো লাগলো প্রতিটি কবিতা, মনোহর এবং পৃথক চিন্তাশৈলীর মাধ্যমে রচিত প্রতিটি লেখা...
    কবি রণজিৎ অধিকারী আমার প্রিয় কবি!

    ReplyDelete
  6. অসামান্য কবিতাগুচ্ছ । এক নতুন ভাষায় , বোধে আলোকিত হলাম । একেবারেই অন্যরকম কথা বলছেন রণজিৎ ।তাঁর নৈঃশব্দের তর্জনী ছুঁয়ে আছে শাশ্বত দিকদিগন্ত

    ReplyDelete
  7. মহিউদ্দিন স্যইফJune 16, 2020 at 3:14 AM

    লেখাগুলি নিঃসন্দেহে ভালো । শব্দের ব্যবহার ও বক্তব্যের প্রাতিস্বিকতা প্রশংসনীয়।

    ReplyDelete
  8. এসব কবিতা বারবার পড়েও স্তব্ধ হতেই হয়।

    ReplyDelete
  9. প্রতিটি কবিতাই চমৎকার

    ReplyDelete
  10. বরফ শৈত্যকে ধারণ না করলে এই গুচ্ছ পাঠ করা যায় না আবার পাঠ পরবর্তী পর্যায়েও প্রার্থনা রাখতে হয় হিম হয়ে যেতে। এ গুচ্ছ এক বোধ নামা।

    ReplyDelete
  11. প্রতিটি কবিতাই অসাধারণ ! প্রতিটি কবিতা বারবার নিবিড়ভাবে পাঠের আবেদন রাখে!

    ReplyDelete
  12. কবিতাগুলি খুবই ভাল লাগল। রণজিতের লেখা সাবলীল। আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে বেশ কিছুদিন।

    ReplyDelete
  13. পাঁচটি কবিতাই অনবদ্য । আপনার ইদানিং কবিতাগুলো পড়ে আশ্চর্য হই । নিজস্ব গুণে পরিপূর্ণ সবকটি কবিতাই । এই কবিতাগুলো নিয়ে একটা গভীর বই হোক । এবং, সে বই হলে আমি তা সংগ্রহ করব । এ কবিতাগুলো বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পড়ে যাওয়ার মতো লেখা । এবং পড়ার পর এসব লেখাকে নিয়ে গদ্য লিখতেও ভাল লাগে । অনবদ্য লেখা । আপনার আরো গুচ্ছ কবিতা পড়তে চাই ।
    ।। শুভদীপ নায়ক ।।

    ReplyDelete
  14. অপূর্ব কবিতাগুচ্ছ। প্রথম কবিতা আমাকে বিস্মিত করেছে। প্রকৃতি ও নারীর এক অনির্বচনীয় উপমা।

    ReplyDelete

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল