কবিতা : উমাপদ কর



মনটা নেই মনের দাঁড়ে বসে। বড়ো বিক্ষিপ্ত তার মতিগতি। বাড়িতেই তার বসত, কিন্তু তার তো ঘোরাফেরা করার অভ্যেসটা যায় না। যেতে পারে না। উচাটন মন গোলার্ধ ঘুরে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে স্বজন-চিন্তা। আশংকার ডালি। আশংকা থেকে ভয়। ট্যালিতে বাড়ছে মৃত্যুসংখ্যা। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কী এক অজানা-অচেনা জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী চঞ্চলতা মানুষকে উপজীব্য করে নিঃশেষ করছে তাকে। এই এতদিনের জীবনে এমনটাতো দেখা হয়নি আগে। রাগ হচ্ছে খুব মানুষের ওপর, কী অত্যাচারটাই না করে চলেছে প্রকৃতির ওপর, সভ্যতার অগ্রসরমানতার নামে। নিজের ওপর খুব রাগ বাড়ছে। আমিও যে তারই শরিক। রাগ একবর্গী হয়ে ভয় বাড়িয়ে চলেছে। তবে কি তারই প্রতিশোধ? ক্রোধ হচ্ছে খুব রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর, রাষ্ট্রশক্তির ওপর। দ্রোহে মন যায়, পারি না। অবদমন ঘটে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মন উদ্বেল হয়, পারি না সেভাবে। অবদমন ঘটে। কয়েকজন বাদে সব রাষ্ট্রনায়কের মুখ যেন এক। একাকার। হাঁটছে, পেছন পেছন। সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না। যেন অনুৎপাদক মানুষের ভার কিছু কমে যায় তো যাক না। দুঃখ হয় খুব, কষ্ট বাড়ে। সইতে হয় সেই মনকেই। আর নিত্যদিন একাকার করে এই চাকাটাকে যারা চালু রেখেছে সেই নিঃসম্বল প্রায় অসহায় মানুষগুলোর মুখ বারবার ঝলক থেকে গেঁড়ে বসে মনে। এড়ানো যায় না। অভ্যস্ত নই। এত অনিশ্চয়তা তাদের কি প্রাপ্য? এত নিদান-দান-কান্না, সত্যিই কি তাদের বাঁচিয়ে রাখবে? প্রশ্নটা ক্রমেই বড়ো আকার ধারণ করে। গড়পরতা মানুষ বড়ো অসহায়। আমি কি এদের বাইরে? কতটুকু দাঁড়াতে পারছি এদের পাশে? অতি সামান্য। তিলাংশের চেয়েও কম। এই অক্ষমতা ক্ষুব্ধ করে মন। তেতো করে দেয়। তিন-তিনটে পৃথিবী দেখি। কোভিদ-১৯-পূর্ব পৃথিবী— যা দেখেছি এত দীর্ঘদিন ধরে। ২য়-- কোভিদ-১৯-গ্রস্ত পৃথিবী— দেখে চলেছি যার অসহ লীলা, জানি না আরও কতদিন দেখতে হবে? আর ৩য়— কোভিদ-১৯-উত্তর পৃথিবী— যা অনেকেই হয়তো দেখতে পাব না, বা অনেকেই হয়তো দেখে যাব। তিনটে পৃথিবীর দ্বিতীয়টাতে আমার বাস এখন। এখন এই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক স্বজনকে যেন ঠিক চিনতে পারছি না। কোথাও কি ভুল হচ্ছে আমার? একটা টানাপোড়েন। এই বিক্ষিপ্ততা, উচাটন-ভাব, আশংকা, ভয়, ভীষণ ভয়, রাগ, দ্রোহ, বাদ-প্রতিবাদ, অবদমন, দুঃখ-কষ্টানুভব, অনিশ্চয়তা, অক্ষমতা, টানাপোড়েন সব মিলিয়ে একটা দুঃসহ চাপ মনের মধ্যে তাঁবু গেড়ে বসেছে। আমার অভিজ্ঞতায় (জীবনের), চাপে কলমের সূচিমুখ খুলে যায় আমার। অনেকবার খেয়াল করেছি কাণ্ডখানা। এইসব লেখাপত্র সেই চাপ থেকে, চাপ-মুক্ত (আংশিক) হওয়ার একটা তরিকা মাত্র। কোনো শিল্পমূল্যের বিশেষ দাবি থাকতে পারে না যার ওপর, আবার হয়তো পারেও। কাল সে ঠিক করুক। আপাতত সে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। সুতরাং- কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স।

উমাপদ কর  •  ১৩-০৪-২০২০


কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স



ক’দিন ধরে একদম দেখছি না ঘরে
                 টিকটিকি
      থাকত, কথা হত, এখন লুকিয়ে থাকলেও
                 শব্দহীন, হয়তো ভয়

পরপর দু’দিন দুটো আরশোলা উলটে পড়ে আছে ঘরে
                  অর্ধমৃত
            ভয় পেলাম। ঝেঁটিয়ে বিদায়ও
        কালো বা লাল ‘হিট’ কিছুই স্প্রে করিনি

গুঁড়ি লাল-পিঁপড়েগুলো দেখছি না দুধের সসপ্যান ঘিরে
            কোথা থেকে আসত রহস্য যেমন
                  কোথায়ই বা গেল!
                      সমান হেঁয়ালি, ভয়

বইগুলো খুললে টিকটিকির গু, আরশোলার মরা বাচ্চা,
                         পিঁপড়ের ডিম-শব
        কালো অক্ষর হয়ে ঘুমে-জাগরণে।
              পড়তে হবে জেগে, রাত কাটানোর
                     নয়া ট্যাবলেট

ঠিক-টকের সঙ্গে কথা হচ্ছে না
      ডিপ-ব্রাউন পাখার শব্দ পাচ্ছি না
           সারি সারি রেখা লক্ষণরেখা ডিঙোচ্ছে না

শুধু বারান্দায় রোজ সকালে মারি-গোল্ড খেতে আসা কাক
            চার বার কা-ক্কা-কা-ক্কা করে ওঠে--
               বারবার শোনা কথা নতুন করে কা-কা
                    ‘লিভ এন্ড লেট লিভ’

২৮-০৩-২০২০




১৯

আসবে কালোরাত্রিটাকে আগেই ডেকে নিলাম
       আদর ও তোয়াজ করলাম খুব
     বললাম— চলো, দুজনে একসঙ্গে দোলনায় দোল খাই

তখন দিন, খাড়া সূর্য, দোলনাটা পাশের বাড়ির বাগানে
       ঘর গড়রাজি, বেরোতে দেবে না
              চটি কাঁদছে
   ব্যালকনি থেকে স্পষ্ট দেখলাম কালোরাত একাই দুলছে দোলায়
           কয়েকটা ফুলগাছ ছাড়া কেউ কোত্থাও নেই

কত যে জিজ্ঞাসার চিহ্নগুলোকে চিহ্নিত করে রেখেছিলাম!
       উত্তর পেতে পারি ও না-ও-পারির মধ্যে
            শংকা লুকিয়ে রেখেছিলাম!
               শরীর হচ্ছে আশংকাগুলো
        এত প্রচুর হইনি আগে কখনও

অমাবস্যাতে কালোরাত, এতদিনের অভ্যস্ত প্রকৃতি
      তার অভ্যাসে গ্যাং-রেপ সয়েছে, মেনে নেয়নি
           তার বিশৃঙ্খলার ন্যাংটোমিকে জামা পরানো
                পাগলাকে মরফিনে ঘুম পাড়ানো, সয়েছে, মানেনি--

দুপুর ১২-টায় বাগানে কালোরাত ১২-টা ছড়িয়েছে
     ব্যালকনিতে তারই আভা, যেন সাঁঝ, আমি দাঁড়িয়ে প্রশ্নের টুনিবাল্ব জ্বালছি,
১৫ গুণ ২৪ ঘণ্টা + ৬ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকব এখানেই
            ওর একটু একটু আলো হওয়া দেখব
                  খাব না, ঘুমোবো না, প্রাত্যহিকীও নয়
             শুধু নিজেকেই শোনাব জমানো প্রশ্নগুলো বিড়বিড় করে
২৪ ঘণ্টার দিন-রাতের কনসেপ্টটা অভ্যাসে এসেছিল
          কালোরাত তাকে পালটে দেবে, দোলনায় দুলছে--
               আমি একটু একটু আলো-হওয়া দিয়ে আমাকেও আলো করে নেব
আলোই উত্তরগুলো শুনিয়েছে এই পনেরদিন, এবার শববাহী-গাড়ি ডাকতে পার!

১২-০৪-২০২০




২০

উদ্বাস্তু মনটা বাস্তু পেল যখন
       ছবিগুলো মুছে দিতে ইচ্ছে হলো
       ইচ্ছে হলো স্মৃতির টবটা ভেঙে মাটি আলগা করি
আরও অনেক ইচ্ছের দখলদারিতে মন
          বালিশের ঢাকা পালটাতে পালটাতে
             কেমন সন্দেহবাতিক

চারপাশে হয়তো ঘুরছে অচেনা
      অবশ্যই ঘুরছে খসড়া প্রশ্ন
            প্রশ্নের মাথায় জবাকুসুম ঠেসেও
      দুর্গা-টুনির পিরিক-পারুক থামে না

নামতার মতো মুখস্ত হয়ে গেল কিছু শব্দ, শব্দ-বন্ধ
         ‘ফেরে পড়া’ যাকে বলে আর কি
কোভিদ-১৯, সাবান-জলে হাত-ধোওয়া, মাস্ক-গ্লাভস-পিপিই, সামাজিক দূরত্ব
      WHO, LOC-DOWN, KITS, TEST, RAPID-RAPID, HOTSPOT
      মৃত্যু চ্যানেলে দু-বেলায় হু-হু, ক্যালানো বলে স্ট্যাডিয়াম ছাড়িয়ে ছক্কা
                 আকাশ বাড়তি নীল, নগরের পারদ
          গত কয়েক বছরের চেয়ে কম উঁচু
                        ফুলের বাজার আজ খুলবে

প্রশ্নের নামতাও মুখস্ত হয়ে এল
          বলছে ৫৫ করছে ৫, কেন?
          কিটস্‌ বলছে আছি, টেস্ট বলছে না-থাকাই, কেন?
          কেন যে হবু-সেলেবের ঘর-ঝাড়ু দেখাও বাপু!
                দেখাও না রিকেট-বস্তির কলাই-করা বাসনের ঠকাস
                           একই ট্যাপ-কলের তলায়?
         আহা দূরত্ব, বাহা দূরত্ব, সে-থাকুক তোদের মনের কোনায়

কিছু মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বোয়ারার খোলে মাছি-মানুষ জমছে, কেন?
        লড়ছে যারা স্পর্শে কিংবা গন্ধে, ঢাল-তলোয়ার জ়ুটছে না আজও, কেন?

রাজনীতি মারাচ্ছো শ্লা? এটাও একটা প্রশ্ন, আপাতনিরীহ, সুদূরপ্রসারী
         উদ্বাস্তু মনটা এখানে বাস্তু-গর্ভে, নাইট-ল্যাম্প নিভিয়ে বসে থাকে, ঘুমোয় না

১৫-০৪-২০২০ 




২১

আনন্দকে বলছি নিরানন্দ হোস নে
      গরম জলে গার্গল কর
         ব্যথা আছে, থাকবে, কন্টিনিউ করবে

নিরানন্দরা সব আটকে আছে
       হয়তো খাচ্ছে, মেঝেতে শুয়ে পড়ছে
           ঘুমোতে পারছে না
       বাড়ি ডাকছে, এই ধ্বনি-কম্পাংক এতই কম, শুধু তারাই
                  শুনছে শুধু তারাই
       বাড়ি শব্দটির মোহ এত যে মোহিনী
                 আগে টের পায়নি শ্রমের ঘাম

ফেঁসেছে, মানুষ-মনের দশাবস্থার ‘উন্মাদ’-টা এখন
            দেয়ালে খড়ির দাগ কেটে চলেছে
                   দেয়ালও ফুরিয়ে এল

টবের গোড়ায় জল ঢালছি
       মানিপ্ল্যান্ট তবু হলুদ হয়ে আসছে
    গলাব্যথা কণ্ঠকে বলছে, বিশ্রাম নে—
          বলির পাঁঠা হয়ে স্বর কাঁপছে

‘আমার করার কিছু নেই’-কে নিয়ে ফাঁকা রক হুতাশে
‘আমাদের করার কিছু নেই’-নিয়ে ভলি খেলছে ১২ জন বিশিষ্ট
         ছোট বাচ্চাটাকে বুকের দুধ দিতে ভুলছে বাড়ির ঘোমটা
                 মা বাড়িটাকেই শাপান্ত করে ভুত বানাচ্ছে
                        কী হবে বারবার হাত ধুয়ে!

ঘা খেয়ে লেজে খেলছে লাউডগা
         আজকের রেসিপি-তে অবশ হয়ে পড়বে
আনন্দকে বলছি, আচার-টা ফুরিয়ে ফেলিস না
         এত পানসে, অনেকটা চুষলেও জিভ টকাচ্ছে না
         ফুরিয়ে তো যাবেই, ফাঁকা বয়মটা রোদে রেখে দিতে হবে--
                       যদি কেউ ফিরে আসে…

১৭-০৪-২০২০




২৩

ঘুমের ড্রয়ারটা টেনে খুললাম
        পায়রা উড়ে গেল
      গেল, কিন্তু ঘরেই বকম-গুম
ভাঁজ করা রুমাল কোনা থেকে দেখালো
      উড়তে না-পারলেও কতটা রঙিন সে
          আটার প্যাকেটটা এখানেই কি রেখেছিলাম!
ছেঁড়া স্বপ্নগুলো তখনো অকাতরে ঘুমোচ্ছে—

হিজিবিজি সব, এলোমেলো, কোথা থেকে এলো!
        সেফটিপিন খোলা, ব্লাউজেই আটকে তখনো
   হ্যান্ড-সেনিটাইজার গম্ভীর মুখে, এতটা খরচের নাকি কথা ছিল না
      আমারই বানানো একটা গ্রাফ-শিট
         লম্বে-আড়ে মিশেছে যেখানে, সেই বিন্দু থেকে
                  বিন্দু-বিন্দু উর্ধ্বমুখী রেখা সঞ্চার
         আড়ে সময় ওরফে দিন, লম্বে মরণ-বেহালার করুণ

হাতড়ে স্বপ্নগুলোর মুখে থার্মোমিটার ভরে দিই
        প্রত্যেকটির ধুম জ্বর, অকাতর ঘুমের কারণটা খুলে গেল
                  বাইরে পাখি ডাকছে
        ওদের ঠোঁটে করে পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে হাসপাতাল
                পাঠাতেই হবে। বিনে-চিকিৎসায় স্বপ্ন গ্রাফ-শিটে স্থান পেলে
        কাকে নিয়ে বাঁচব, ঘুম থেকে উঠে কার রেশ বইব গোটা দিন
                   সামান্যটাই বা কার মনে করতে চেয়েও পারব না
                   হা-পিত্যেশ করব, অনেকটাই মিসিং লিংক
                   কার কাছে দাবি করব, কিছুটা আবার দেখতে চাই গো!

খুলল ঠিকই, বন্ধ হতে চাইছে না ড্রয়ারটা
      খোলা-ড্রয়ার শিয়রে রেখে ঘুম-বিছানায় যেতে হবে
      আয় পায়রা, বন্ধ হয়ে যা সেফটিপিন, গ্রাফ-শিট তুই আগে ঘুমো--
              জেগে আমি গান করি ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’।

১৯-০৪-২০২০

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

2 comments:

  1. সবটা পড়লাম। বাস্তবের দলিল। এই লেখাগুলো থেকে যাবে।

    ReplyDelete
  2. অসম্ভব ভালো। যে মনটি এর রচয়িতা তার সব বেদনা ও আশংকা যেন মরমে পৌঁছে গেল। অথচ এও যে নির্মাণ তা যেন খেয়ালই থাকে ।। প্রণাম মনটিকে ও কলমটিকে।

    ReplyDelete

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল