কবিতা : অরুণ পাঠক



আলো 


আলোকে চোখের কোণে রাখি । দুরূহ তারার মতো স্বচ্ছ ও নরম
ওই জাদু তার প্রতিচ্ছবি খোঁজে । হয়তো কিছুটা কেউ সে তারার
অধিকার নিয়ে আছে, তাকে আমি বাজালাম মনের মানুষী।
অন্যতর কাঁটা, ক্ষত বুকে নিয়ে সবাই রাস্তায় । রাস্তাই শাশ্বত 
প্লাটফর্ম । সমস্ত হিংসার বাইরে থাকা সবার দুনিয়া। সেখানেই 
রূপের আধার থেকে বিযুক্ত তোমাকে দেখে চোখ ভিজে যায় ।
এ গ্রহ প্রেমের রঙে নীল। মৃত্যুর পাহারাঅলা ওই সব সংযমী আলো
মহাকাশ থেকে আমাদের মন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে ।




মেঘ


নকশাকাটা জানালার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে দিলে 
এখন বর্ষা নয়, তবু জল এসে ভরে দিল হাত । জল চায় 
হাতের তর্পণ, ঘর চায় অধিকার । আকাশ এ হেন সম্পর্ককে
দুদিকে টেনে রাখে। আমি ভাবি তোমার বজ্রনত চোখ
আতস ঠোঁটের বৈশালী পার হয়ে মেঘের নতুন রূপ
হৃদয় হয়েছে । সে শুধু বাহক নয়, নায়কও । পরিবেশ ,
স্বচ্ছ জীবন কৌমুদী । একা, উৎকণ্ঠার শুধু গলা কেঁপে ওঠে।
সে তোমায় ফিরিয়ে দেয়,  আঙুলে আঙুল রেখে
বিগত জ্যোৎস্নায়।




জীবন 


জীবন সামান্যতম আলো । অন্ধকার এত বেশি হাজার নক্ষত্রও কিছু  নয়
তার। আলো মানে বন্দি দশাটুকু। মুক্তিকে অদৃশ্য করে রেখেছেন তিনি ।
সেই অটুট বিশ্বাস থেকে  জলের লাবণ্য, হাওয়ার কোমলতা ও আলোর
অভিজ্ঞান । ভয় পাই। দরজার আড়ালে আড়ালে,  ঘর ভরা ছায়ায় ছায়ায় 
খুঁজি তাকে। লালসা শৌখিন করে কাঁদি। চেতনা এমন এক তির
আত্মবিদ্ধ হতে হয় । তখন সমস্ত কথা মহাজাগতিক । বিস্ময় ও বেঁচে থাকা 
এক নয়। পৃথিবী অসুস্থ বেঁচে থাকা জীবে। এ এক পরীক্ষাগার । এই তো কয়েকটি দিন
হল আমরা জগতে এসেছি। আমাদের বর্ণনীল গ্রহে এক অন্ধকার পা রেখে তিনি
বলছেন জড়ত্বের আলো এসে গেছে । তোমরা তার স্নিগ্ধতা পান করে
মৃত্যুর কাছে যাও। বারবার মৃত্যুর কাছে।




পোড়াও 


আগুনে আগুন লাফায়। প্রতিদিন রহস্য জোনাকি তার ডানা খুলে
 ওম রাখে দুর্বাক্ষততে। তখন হৃদয় জ্বলে ঝিকিমিকি তারার প্রভায়।
তখনও কি সন্ধ্যার হাতটুকু প্রগলভতার চূড়া স্পর্শ করে
মেরুজ্যোতি নিয়ে আসে মস্তিষ্ক শিরায়? স্থির অভিভবে আমি যত
শান্ত, তত ক্রিয়াশীল শ্বাপদের প্রভুত্ব ঘুচে যায়। কী সুখ কী সুখ, 
পোড়াও পোড়াও এই গৃহ, বাসা, ভালোবাসা,  প্রবর্তনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি।
ডাঙার গহীন স্বপ্ন স্তূপীকৃত জলের কুমীরে। মোনালিসা জল
কান্নার তীব্রতা হাসিতে ফাটিয়ে দিচ্ছে। আমার শরীর স্পর্শ করে 
নেমে যাচ্ছে স্থির হিমানলে। আমি আর প্রতিটি প্রাণের সঙ্গ
এভাবেই নির্মম প্রকৃতি হয়ে ওঠে।




প্রস্তুতি 


হতশ্রী মূর্তির দিকে ভালো করে দেখি, হতশ্রী বিবেক এসে যায় 
চেতনার এক স্তরে ফুল-মালা গাঁথা, আর স্তরে মর্মর তন্ময় ।
কীভাবে বা বুঝি সংকটে বেলা ফুরাবার গান অস্ত বিনির্মাণ 
নিয়ে আসে। পাখি বা প্রকৃতি, পশু বা প্রত্যয় এ সময় খুব 
বিনায়িত হয়ে ওঠে । মানুষ তো শ্মশানকাতর,  সময়ের ক্রান্তদর্শী 
চোখ তাকে দেখে--- তাই তাকে পুজো করি, সে সন্ধ্যার মেঘমালা
এসে যাবে বলে প্রস্তুত হতেই হয়, এই ভেবে যতবার যোগ্য হয়ে উঠি
ততবারই কম কম লাগে। মনে হয় সার্থকতা শুধু একটি ক্ষমার ওপার,
বার বার ভেঙে চুরে যাওয়া যথার্থ নিজের সীমানাকে ভেদ করে 
হয়ে উঠি পূজ্য ও পূজক--- দিগন্ত সাদা করে সে সময় হেসে ওঠে বক।




যোগ্য 


পিছিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি । সময়  নিচ্ছে না। মুহুর্মুহু বদলে
যাচ্ছে আকাশের রং, সেই সঙ্গে মেঘ ও হাওয়ার জীবন । 
ক্ষমা নয় আরও শক্তি, আরও অর্জনের আকুতিকে 
আমি চাই। পাহাড়ের শীর্ষদেশ, পাতালের অন্ধকার, 
কেন্দ্রের আগুন--- সবকিছু বিস্ফারিত চোখের নমুনা । 
বোধোদয় ব্যক্তিগত সম্পদ কোনও নয়। তা শুধু 
জড়িয়ে থাকে স্বতন্ত্র বিচ্ছেদ ভরা আলোয় আলোয় । আমার
ব্যক্তিপুরুষে যে সমাচ্ছন্ন আকাশ, তাকে কলকাকলির মতো 
সুরে সুরে  ভূবনায়ন করেছে পাখি, নানা রঙের বৈচিত্র্যে
বাঙ্ময় করেছে ফুল --- তবু তারা আজ আর কাল এক নয়
কখনওই, বিচ্যুতি বা বিস্তীর্ণতা প্রকৃতির কাজ। আমার আগ্রহে
তেমন মহত্ত্ব কখনও কখনও ধরা দেয়, কখনও বা যোগ্যতর 
হতে বলে আরও দূরে ডাকে।




প্রণাম 


নেচে উঠবার আগে যে ধরিত্রীকে প্রণাম করো, ধরিত্রী তা কীভাবে 
গ্রহণ করে? কোনও এক নটরাজ আছে, আছে জগন্নাথ,  তাছাড়াও
নেই কি প্রতিভূ কোনও হৃদয়ের? বিস্মিত মহামেঘ থমকে দাঁড়ায় ।
অজানিত সুখের দরজায় সমস্ত গ্রহেরা ঝুঁকে থাকে। আকাশের দিকে 
দেখো: কোনও দৈবযোগ আঙুলে আঙুলে মুদ্রা, দেহে রেখাপাত, প্রকৃতি-স্বজন 
হয়ে আছে । যে বুকে পা রাখো শান্ত, অসীমের মাথা, শুধু তুমি বোঝো
অসীম বল্লরী।




মেয়ে 


আমি যখন কবিতা লিখি, আমার মেয়ে আমার সামনেই নাচতে শুরু করে ।
মুখে প্রয়োজন মতো গান। ফলত আমার কাছে সে সময় যে দেবদূতেরা 
আসেন তাঁরা আমার মেয়ের দিকে তাকান। নিজেকে তখন কুরুক্ষেত্রে  কর্ণের
মতন মনে হয় । আমার সমস্ত শক্তি আর প্রখরতা দিয়ে মেয়েকে অতিক্রম 
করতে চাই। কিন্তু ততক্ষণে থই থই সমুদ্রের এমন এক বিচিত্র 
বেলাভূমি আমাকে টানে, আমি হেরে যাই। সভ্যতার এমন এক
 ক্লান্তির দিনে ঝরে যাবার দু-চার কথা লিখে রাখার সময় 
দেবতারা এমন অলস হয়ে যান যে তাতে লজ্জা পাই আর
আনমনে একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি দেবী সরস্বতী 
তাঁর লাস্য দিয়ে ভোলাতে চাইছেন আমায়।




পঁচিশে বৈশাখ 


গলায় চিনচিনে ব্যথা । তিনি তবু আকুলতা ঝরিয়ে বসে আছেন।
জীবনের মহৎ খণ্ডাংশগুলো নামিয়ে দিচ্ছেন তিরতির করে। সরোবর 
থেকে সমুদ্রে গিয়ে মিশছে সে সব। প্রতিটি উৎসই একটি অবয়ব পেতে
চায়। উৎসমাহাত্মে সে অবয়ব সংখ্যাবিহীন। স্মৃতির মাতৃত্ব 
অধিকার করে এইভাবে নিরবচ্ছিন্ন বসে থেকে মস্তিষ্ক লাঙল চালানো
তাঁর পক্ষেই সম্ভব ।

আমি শুধু কান্নার বদলে গেয়ে ফেলি




পূর্ণিমা 


পীড়িত রাতের কাছে পূর্ণিমা অধিক জ্বালাময়। বিষাক্ত আলোয় ভরা
চন্দ্রাতপে কেউ পোড়ে কেউ উদাসীন । তবু সে উদাসীনতা কখনও কখনও 
জয়ী হতে আসে। ভাগ্যের বিরল অন্ধকারে যে পুড়ছে তার চোখে চাঁদ ভরে
কক্ষপথে ছেড়ে দেয় । অবনত হতে থাকে পৃথিবীর মাথা। যখন পূর্ণিমা তখন 
জানিও, কেউ জন্ম নিচ্ছে --- বিহারে, বাংলায়। আমরা ঈর্ষাপত্রে লিখি, হিংসাপত্রে খাই
আর উপজীবিকার জন্য রাজা-প্রজা সাজি। জ্যোৎস্নায় জারিত সে রাতের নকল 
যৌনবোধে উদ্দীপিত করে। আমরা ভুলে যাই বিশুদ্ধ ভাতের মতো মাসে এক একটা 
রাত আসে, যেদিন সমস্ত শস্যক্ষেত্রে আলো কমের যায়।

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

0 comments:

Post a Comment

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল