কবিতা : সোমেন মুখোপাধ্যায়


ছায়া


পুকুরপাড়ে একদিন নজরে এল আমার ছায়া জলে নেমেছে। ঘাটের পিছল দেখে বলে উঠি - আস্তে নামো। তারপর দীর্ঘক্ষন ঐ একই রকম - আমি পাড়ে, ছায়া জলে। সূর্যের তেরছা আলো পাড়ের তালগাছ ডিঙিয়ে মাঝজলে খেলা করে চিকচিক চিকচিক! পানকৌড়ি উবু হয়ে ডুব দেয় তখন। 

আমিও তো কতবার ডুব দিয়েছি জলে। কিন্তু আমার ছায়া এত ভীতু, আমি ডুব দিলেই সে উধাও। ছায়া ডুব দেয়না কোনদিন। হ্যারিকেনের অল্প আলোয় যখন পড়তে বসি, দেখি ছায়া এসে হাজির। আর একটা ফড়িং ছায়ার মাথায় দোল খাচ্ছে...




ভাসান


হাঁটুজলে একে একে বিসর্জিল নবপত্রিকার সাজ। দেবীমুর্তির প্রারম্ভিক নিরঞ্জনপর্ব। পুকুরপাড় থেকে ঢাকের শব্দ নেমে আসছে জলে। ভাসানের যাত্রীসকল একে একে ভাসিয়ে দিচ্ছে অপরাজিতার অঙ্গুরী। কাঁচা হরিদ্রার হলুদাভ তাদের গলায়। পুকুরটি তখন সম্পূর্ণ ডুবে তার জলে। পুকুরের আশ্রয়ে থাকা জলজরা ভাসান শোনে। দেখে, বিষাদ কিভাবে মুখ লুকায় জলে।

এদিকে প্রতিমা গড়ার কারিগর, যিনি দেবীর চোখ আঁকতে গিয়ে পুকুর এঁকে ফেলেছিলেন একবার। উন্মত্ত ভক্তের দল আর মাফ করেনি তাঁকে। সেদিনই তাঁর এই জীবিকার সলিল সমাধি হয়েছিল এ তল্লাটে। আজ এত বছর পরেও সেই বৃদ্ধ কারিগর কাউকে বোঝাতে পারেননি, পুকুর আর বিসর্জনের সাথে চোখের সম্পর্কটুকু।




আকাশ 


বেড়-বাদাড় টপকে শীত এবার যাব যাব করছে। মাথা নিচু চালাঘরের উপরে বৃদ্ধ পুঁইলতাটি থুতুক সাপের মত পড়ে আছে। ধুঁয়া ভর্তি ঘরে মালসায় রাখা ইঁদুর -চেড়ুর মাংসে হলুদবাঁটা মাখাচ্ছে লম্বু হাঁড়ির বউ। কড়াচ ফেলা উঠোনে ভ্যাবাচ্ছে পাঘা বাঁধা পাঁঠিছাগলটি। কাজকামহীন হাঁড়িপাড়ার ঝাঁপড়িথানে ঘুঘু ডাকছে একনাগাড়ে। 

বিন বিন করে যে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে চালা ভেদ করে, সে ধোঁয়া কি আকাশে আটকাবে?  রামধনুর আকাশে পোড়াহাঁড়ির কালি শিকেয় তোলা থাকে।




রাত কুটুম


অন্ধকারে ফুল চুরি করে নিয়ে গেছে বলে সকাল হতে বিলম্ব হচ্ছে। ফুল তো শুধু গাছের আনন্দ নয়, আসলে আলো। এরকম অনেক অনেক আলো নিয়ে সকাল হয়। পা ডোবা জোড়ের জলে ঘুগি আড়া থাকে। আঁশটে অন্ধকারে ভেসে আসে জিয়লমাছ আর জলপোকারা। ফাঁদের ভেতরেই তারা পথ হারায়। সূর্য ওঠার বহু আগে জেলেপাড়ার মনসা মন্দিরে মাড়ুলি পড়ে। এইসব আলো-আঁধারি গল্পের মাঝে এসে পড়ে অন্নচিন্তা! ফুলচোর, মাছচোরদের পাড়ায় শুরু হয় আলোকথা। 

গাছ ও নদী জেগে থাকে, রাতের কুটুম আসবে বলে...




পাখি ও অর্জুনগাছ 


এই অফলা ধানজমির আলে দাঁড়িয়ে থাকা অর্জুনগাছটি কোনদিনই খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। শুধু বছরান্তে লু-লাগা হাওয়া গায়ে ভিনদেশি পাখি শিকারীদের এর তলায় জড়ো হতে দেখি। তাদের ভাষা ও ইশারায় শঙ্কিত ছুটে বেড়ায় লোমশ চেড়ুগুলি। কোটরের অন্ধকারে হাঁ- মুখো ছানাগুলি অবুঝ কেঁপে ওঠে। গাছের গোড়ায় লুকিয়ে থাকা বাদামি ইঁদুর তার লেজটুকু আরও ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। পাইখমারার দল বিচিত্র শিস দেয় লোভে ও লালসায়। সঙ্গী কুকুরগুলো গলা তুলে মগডালে তাকায়। গাছ কেবল তার পাতার নড়াটুকু দেখে। 

এই দৃশ্যের পাশে বড় একা আমার পাখি আঁকাটুকু। অর্জুনের বাকল ছাড়িয়ে একটি পাখি এঁকেছিলাম। পাখিটি আর বাসায় ফিরল না কোনদিন...

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

2 comments:

  1. ভাসান, পাখি ও অর্জুনগাছ খুব ভালো।

    ReplyDelete
  2. কবি সোমেন মুখোপাধ্যায়ের কবিতা গদ্যে আঁকা দুপুরপাখি।

    ReplyDelete

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল