আলোচনা : দেবদাস আচার্য



নিহিত নির্জন অবগাহন 



       তোমার দিকে চেয়ে আমি বুঝতে পারি 
         সকল নিস্তব্ধতার ভিতর একটা সংগীত রয়েছে

কবি গৌতম মণ্ডলের কাব্যগ্রন্থ 'অরচিত অন্ধকার'-এর  প্রথম কবিতা 'গান' থেকে উদ্ধৃত দুটি পঙক্তির দ্যোতনা অবলম্বন আমরা এই কাব্যগ্রন্থে অনুপ্রবেশ করতে পারি। উক্ত কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই মন্ময় শান্ত স্বরের কবিতা। আকাশ,নক্ষত্র, মহাশূন্য,জ্যোৎস্না, জল-স্থল এবং শূন্যতা ইত্যাদির সন্নিবেশে এক মহাব্যাপ্ত ও বিমূর্ত জগৎ থেকে কুড়িয়ে আনা এক-একটি পূর্ণস্ফুট সতেজ কুসুম যেন কবিতাগুলি।

         সকল বন্ধনের বাইরে আছ তুমি
           তাই তোমাকে অক্ষর দিয়ে 
           রচনা করা যায় না
                                     (তুমি)

কিংবা

          সকল কল্পনার বাইরে চলে গেছ তুমি
            
             তাই রঙ দিয়ে
             আঁকা যায় না তোমার মুখ
             মুখের ইশারা
                                (নিবিড়তা)

এই কাব্যগ্রন্থের এই হল মর্মকথা। সকল বন্ধন,সকল কল্পনার বাইরে যে নিগূঢ় জগৎ রয়েছে,তাকে অক্ষরে বা রঙে রূপ দেওয়া যায় না। সেই নিগূঢ় ভাব-স্তর বা ধ্যানের চিত্রটি হয়ত বোধে আসে, কিন্তু বাণীতে আসে না। এমনই এক বিমূর্ততার মধ্যে,অরচিত অন্ধকারে,ফুটে থাকে ফুল।


কবি গৌতম মণ্ডল


খোশমেজাজে গৌতম

কোলাহল শান্ত হয়ে এলে শূন্যে ফুটে ওঠে ওঠে একটি-দুটি তারা। সন্ধ্যার স্তব্ধতা কিংবা নিখিল অন্ধকারে ফুটে ওঠা সেই একটি-দুটি তারার আলোয় যেন একাকী ঈশ্বর উঠে দাঁড়ান। লাইট হাউস থেকে দেখা যায় গাছেদের অবাক সন্তরণ। একা চাঁদ ওঠে। সমুদ্র ও সন্ত্রাস পার হয় চাঁদ। 
এভাবে আকাশ, শূন্যতা, জন্ম-জন্মান্তর যাত্রাপথের দুপাশে দুলে ওঠা ধানের শিষ এবং জ্যোৎস্না ও অন্ধকার পেরিয়ে চলে গৌতমের কবিতা। এক অচেনা ভুবন যেন ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে পরপর। কখনো-বা মনের কথা চোখের জল হয়ে ঝরে অবিরল।
গৌতম এ-ও বলেন

            'গাছের সব পাতা
               যদি ঝরে যায় 
               তবু গান বন্ধ হবে না।'

কবি মাত্রেই রোমান্টিক। গৌতম নির্ভার রোমান্টিক কবি। তাই তিনি বলেন
      
              'তুমি আসো বা না আসো
               পদ্ম ফুটবেই গোপন দিঘিতে।'
               
কিংবা                  
     
              'জোনাকির নরম আলোয়
               দেখি,ওই আলোয়
               মিশে আছে আমার নিজস্ব অন্ধকার'

প্রত্যেকের মধ্যে এমন একটা নিজস্ব অন্ধকার থাকে, যা, গৌতমের ভাষায় বলা যায় 'অলৌকিক ঘ্রাণ'।


শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে গৌতম মণ্ডল, পিছনে অরুণাভ সরকার

দুই

গৌতমের কাব্যভাষা নিয়ে দু-চার কথা বলতেই হয়। ভাষা তো ভাবের বাহন। গৌতমের কবিতার ভাষা কেমন, তা একটু উদ্ধৃতি তুলে বলা যাক -- আপন মনে ভিজে চলেছে একলা ধুলোগাছ',

              'পথের নীলিমায়
              উড়ে যায় চঞ্চল পাখি'

              'অপরিচিত অন্ধকারে বাজতেই থাকে
              বিষণ্ণ রাত্রির সানাই'

               'ক্রমে ক্রমে গাছেদের কথায়
               আকাশ বাঙ্ময় হয়'

               'ক্রমে উঠোন মুছে গেলে
               স্পষ্ট হয় নীহারিকালোক'

               'পাখিকে ঘিরে
               আরো বহু পাখির জ্যোৎস্না',

               'ধুলোর শরীর থেকে যে গান ওঠ
               বিষণ্ণ হয় না তার সুর'। 

এ ভাষা একান্তই গৌতমের আত্মপরিচয়ের দ্যোতক। যে কবি এমন এক আশ্চর্য কাব্যভাষা আয়ত্ত করতে পারেন, তার সিদ্ধি অনিবার্য। 


কলকাতা বইমেলায় নিজের প্রকাশনা আদম থেকে গ্রন্থ প্রকাশের সময়
ডানদিক থেকে, কালীকৃষ্ণ গুহ, হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম বসু, শুভাশীষ ভাদুড়ি, সুব্রত চক্রবর্তী, শুভদীপ সেনশর্মা


তিন

বাংলা কবিতা জীবনানন্দ দাশের করস্পর্শে ধন্য হয়ে ক্রমে ক্রমে সংস্কারমুক্ত হতে হতে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে, তাকে আমরা আন্তর্জাতিক মান বলতে পারি। গৌতমের কবিতা আন্তর্জাতিক মানের।তাঁর কবিতা নিরাভরণ-সুন্দর। বাচনশৈলীর পরিমিতিবোধ ও নিবিষ্ট উচ্চারণ গৌতমের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আবারও কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার করি

     ১. রাত্রি একপ্রকার মেঘ
          তা ভেসে ওঠে আলোকিত শূন্যের 'পরে৷    
                                                       (শোকগাথা)  

     ২. পাখির আকাশের ভিতর 
          আরও বহু অচেনা আকাশের ইশারা
                                                        (ইশারা) 

      ৩. আকাশের সমর্থন পেয়েছি
          তাই ভিড় থেকে সরিয়ে নিয়েছি নিজেকে
          রাত্রি হয়ে জল হয়ে,জলের বিন্দু হয়ে 
          মিশে আছি হাওয়ায়, হাওয়ার প্রতিটি বাঁকে
                                                            (দুয়ার)

      ৪. আমিও, অন্ধ যেভাবে আঁকড়ে থাকে থাকে
          তার আঁধার,ধরে আছি সকল গৃহরেখাভার
                                                         (গৃহরেখা)

উদ্ধৃতির ভার আর বাড়াতে চাই না। পাঠক একটু আভাস পেয়েছেন হয়ত এতক্ষণে।


অরচিত অন্ধকার
গৌতম মণ্ডল
আদম
মূল্য ১৮০.০০
প্রকাশকাল কলকাতা বইমেলা ২০২০
প্রচ্ছদ শোভন পাত্র

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

1 comments:

  1. উজ্জ্বল ঘোষJune 3, 2020 at 12:35 PM

    এই বইয়ের মুগ্ধ পাঠক আমি । দেবদাসদা'র লেখাটি অপূর্ব।

    ReplyDelete

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল