কবিতা : প্রদীপ সিংহ



ভেষজ


পৈরাগের এক হাতে ছিল হালের বুঁটা
অন্য হাতে ঘাসপাতা , শেকড় বাকড়

তার একপথে অজ্ঞানতার নিবিড় আঁধার
অন্যপথে ছিল জলের খোঁজ , জ্ঞানের খোঁজ
সে ভেষজের ভেতর আয়ু ও
মাটির ভেতর সত্যের খোঁজ জারি রেখেছিল

প্রশ্ন তাকে হতাশ করেনি কোনোদিন
সে প্রশ্নের পর প্রশ্নে পা রেখে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল
শুকিয়ে ওঠা ধানখেতটির দিকে

সে জানত পৃথিবীতে অমৃত বলে কিছু নেই
কিন্তু বিষ আছে , আর আছে জ্ঞানান্বেষণ
তাই হাতে তুলে দেওয়া বিষ সে পান করেছিল
আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে নয় , পূনর্বার
শরীরের নশ্বরতা প্রমান করার উদ্দেশ্যে




বয়স


এই যে বুড়ি দুহাতে জল ভর্তি বালতি নিয়ে আসছে
তার বয়স একশো বছর
এগারো বছর বয়সে সে বিয়ে হয়ে এ গ্রামে এসেছে
তিনটি গ্রাম পেরিয়ে পায়ে হেঁটে ধানখেতের আল দিয়ে
এই গ্রামগুলির বয়স দেড় হাজার বছর
তার হাতের বালতি দুটির বয়স দুশো বছর
তার শাশুড়ি তাকে বালতি দুটি দিয়ে গেছে
তার নাকে রূপার নাকছাবিটির বয়স পাঁচশো বছর
তার শাশুড়ির শাশুড়ির শাশুড়িরা পরম্পরা অনুসারে
বউদের দিয়ে এসেছে এই নাকছাবি
যে কুয়ো থেকে সে জল আনছে তার বয়স সাতশো বছর
দেড়শো বছর আগে কুয়োটি বাঁধানো হয়েছে ইঁট দিয়ে
কুয়োর পাশে বটগাছটির বয়স হাজার বছর
বটগাছের নীচে কুড়চি আর ধুতুরা ঝোপ
এইসব ঝোপঝাড়গুলির বয়স তিন হাজার বছর
উলটো দিকের চাটান পাথরটির বয়স বারো কোটি বছর




পরম্পরা

দুলালচন্দ্র দাস গুরু প্রেমানন্দের শিষ্য , গুরুর মৃত্যুর পর বর্তমান
আশ্রমধ্যক্ষ । পরম বৈষ্ণব ও ক্রনিক আমাশার রুগি । ঔষধ পথ্য , কৃচ্ছসাধন
কোনো কিছুই কাজে আসেনি । শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলে বলতেও মাঝে মাঝে উঠে
যেতে হয় পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে ।  এই জঙ্গল , পুষ্করণী তাঁর বড় প্রিয়।

আশ্রমের উঠোনের একদিকে বিশাল নিমগাছ । রাজ্যের পাখির বাসা । চারদিকে
গাছগাছালি । লোকালয় থেকে দূরে আশ্রমটি প্রায় জঙ্গলে ঘেরা ।  সন্ধ্যায়
আরতির শব্দ ও পাখিদের ঘরে ফেরার কলরবে গমগম করছে ।  একটা সান্ধ্য
প্রকৃতিক বন্য সুঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে ।

গুরু বলতেন বৈষ্ণবীয় তন্ত্রের গতি বংশপরম্পরায় নয় , গুরুশিষ্য পরম্পরায় ।
 আজ শিষ্যরা প্রায় কেউ আসেননি । তাই মঠ নির্জন । এইসব ভাবতে ভাবতে
দুলালচন্দ্র নিম্ন উদরে বেগ অনুভব করেন । উঠে যেতে যেতে ভাবেন , হে দয়াময়,
হে প্রকৃতি মাতা  - এ পরীক্ষার কি কোনো শেষ নেই ।  বংশ পরম্পরা অতিক্রম
করে গুরুশিষ্য পরম্পরা অবলম্বন মানুষের ইচ্ছাধীন নয় ।




ভাঙা চাটু


ক’বছর আগে কাশিপুরের হাটে বলদ কিনতে গিয়ে জানকির বাপ যে ঢালাই লোহার
চাটুটি কিনে এনেছিল , সেটি এতদিন ঘষা খেতে খেতে অর্ধেক হওয়ার পরও
অব্যাহতি পেল না ।  এখন পাঁশ কাড়ার সময় ছাড়া উনুন আর দেওয়ালের খাঁজটিতে
অন্ধকারে শুয়ে থাকাই তার কাজ ।

পানকৌড়ি আর বালিহাঁসদের সঙ্গে কিছুক্ষন জলসাঁতার ডুবসাঁতার দিয়ে কলসি
কাঁখে ফিরে আসার সময় জানকির মায়ের গেল বছর চৈতমেলার হাটে কেনা তেল মাখা
বাটিটি কলসির মুখে প্রতি ডেগে ঠুনুক ঠুনুক বেজে ওঠে । স্নান সেরে এসে ভাত
বসাবার আগে সে বড় তরফে গেল আগুন চাইতে ।

বড় ভাসুর বৃদ্ধ হয়ে আর এখন খেতবাইদ যায় না , তবু তার কাজের ছুটি নেই ।
উঠোনের একপাশে ভাঙা বেড়া বাঁধতে বাঁধতে সুতো বাঁধা চশমার ফাঁক দিয়ে
জানকির মাকে আসতে দেখে আন্দাজে দুটো গলা খাঁকারি দেয় ।
জানকির মা ভাঙা চাটুতে দুটুকরো জ্বলন্ত আঙরা নিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে পাশ
দিয়ে চলে যায় সট্ সট্ ।




ভাই


ষষ্ঠীচরণ কদাচিৎ বাড়ি ফিরিয়া আসে । সেই কখন কৈশোরবেলায় বাপের সঙ্গে ঝগড়া
করিয়া ঘর ছাড়িয়াছিল , বহুদিন আর ফেরে নাই । অনেকগুলি রহস্যময় বৎসর পার
করিয়া সে ফিরিয়া আসিল । এখন যখনই আসে তখনই বোম্বাই নিবাসী জনোচিত একটি
কালো চশমা দিনরাত তাহার চোখে লাগান থাকে । অনেকে ভুল করিযা ভাবে
রামচন্দ্রপুরে সদ্য চোখ অপারেশন হইয়াছে।

সে ফিরিয়া আসিয়াছে, বৃদ্ধ বাপমাকে ফেলিতে পারে নাই। এখন সে ভাই হইয়াছে।
দুবাই নিবাসী ইব্রাহিমের মাসতুতো ভ্রাতার ভাইগিরির দলে হাপ্তাবাসুলির
কাজ করিয়া থাকে। কাজে নাম করিয়াছে। রোজগার পত্রও ভালো। ছয়মাস নয়মাসে
বাপমাকে টাকা পাঠায়। একটি ছোট একতলা ঘরও বানাইয়াছে। এই বয়সে বাপমা
খাটিয়া খাওয়ার হাত হইতে অব্যাহতি পাইয়াছে । এই বা কম কী। এও তো সকলে পায় না।

Share this:

ABOUT THE AUTHOR

Hello We are OddThemes, Our name came from the fact that we are UNIQUE. We specialize in designing premium looking fully customizable highly responsive blogger templates. We at OddThemes do carry a philosophy that: Nothing Is Impossible

8 comments:

  1. খুব মৃদু অথচ শাণিত একটি স্বর

    ReplyDelete
  2. গল্পের আভাস নিয়ে স্বতন্ত্র এক সৌন্দর্যে লেখাগুলি ভাস্বর
    - শাশ্বতী সান্যাল

    ReplyDelete
  3. গল্পের আদলে মানুষের বহুমাত্রিক চরিত্র ও চিরকালীন বহমান পৃথিবীর ভেতর যে বিষয়হীন কবিতার অমোঘ ইঙ্গিত তার সামঞ্জস্য এবং কবিতার সময়হীন ভাবনার তরঙ্গবিন্দুগুলো ছুঁয়ে গেলো এক ভাবুক দার্শনিকতাকে ... খুবই ভালো লাগলো এই. মৌলিক চলন

    ReplyDelete
  4. ঠিক এতটা প্রত্যাশা নিয়ে পড়া শুরু করিনি, কিন্তু ঘাড় ধরে প্রতিটি লেখা পড়িয়ে নিলো। একেকটি চরিত্র তুলে নিয়ে তার মধ্যে চিরন্তরতার এক দর্শন যৌক্তিক ভাবে চালান করবার চেষ্টা অভিনব লেগেছে। কবিতায় চরিত্র আসা নতুন কিছু নয়, কিন্তু চরিত্রকেই কবিতা করে দেওয়া কিছুটা ব্যতিক্রম তো বটেই !

    ReplyDelete
  5. ভীষণ সুন্দর লেখা। মুগ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  6. অসাধারণ সব লেখা। মুগ্ধ হলাম

    ReplyDelete
  7. অসাধারণ, প্রদীপ। খুব ভালো লাগল

    ReplyDelete

সম্পাদক : শুভদীপ সেনশর্মা
সহ-সম্পাদক : মৌমিতা পাল